মাংসের বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিভিন্ন লেখক এবং গবেষকগণ মাংসকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তবে সাধারণভাবে সংজ্ঞায়িত করলে বলা যায় যে, মাংস হল গবাদীপশুর বা পাখীর শরীরের টিস্যু (অনেক কোষ যখন একসঙ্গে একটি বিশেষ কাজ সম্পাদন করে তখন তাঁকে টিস্যু বলে) বা মাংসপেশী (SKELETAL MUSCLE) । পশু বা পাখী জবাইয়ের পর এইসব টিস্যু বা মাংসপেশীগুলি কিছু জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে মাংসে রূপান্তরিত হয়। এইসব টিস্যু বা মাংসপেশী থেকে যখন প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কোন মাংস জাতীয় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদিত হয় (কর্নড্ বিফ, বিফজার্কি, হট ডগস, টিনজাত মাংস, চিকেন নাগেটস্ ইত্যাদি) তখন
ঐ প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্যদ্রব্যগুলিও মাংসের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
যে কোন প্রাণীর শরীরে তিন ধরনের পেশী (MUSCLE) থাকে যথা-
১) মাংসপেশী (SKELETAL MUSCLE)ঃ
মাংসপেশী হল প্রাণীর কঙ্কালতন্ত্রের একটি অংশ এবং এই পেশীগুলি হাড়, টেহুন এবং লিগামেন্ট এর সাথে যুক্ত থেকে প্রাণীকে চলাফেরা করতে সাহায্য করে। মাংসপেশী একমাত্র পেশী যা ঐচ্ছিক বা স্বেচ্ছাক্রীয় (VOLUNTARY) এবং প্রাণী তাঁদের প্রয়োজনে ইচ্ছামত নড়াচড়া করতে পারে। এই কারণে প্রতিটি মাংসপেশীর কোষ (SKELETAL MUSCE CELL) একটি স্নায়ুকোষের (NERVE CELL) MOTOR NEURON এর সহিত যুক্ত থাকে। যার কারণে প্রাণীরা প্রয়োজনের সময়ে ইচ্ছামত তাঁদের স্নায়ুকোষ এর মাধ্যমে উদ্দীপনা দিয়ে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করতে পারে। মাংসপেশীর কোষগুলো সিলিন্ডার আকৃতির এবং উভয় প্রান্ত সূচালো হওয়ায় SKELETAL MUSCLE FIBER বা মাংসপেশির তন্তু হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
২) মসৃণপেশী (SMOOTH MUSCLE)ঃ যা প্রাণীর মূত্রথলী, পাকস্থলী এবং ক্ষুদ্রান্তের দেয়ালে থাকে;
৩) হৃদপেশী (CARDIAC MUSCLE)ঃ যা প্রাণীর হৃদয়ের (HEART) পেশীতে থাকে।
১) মাংসপেশী (SKELETAL MUSCLE)ঃ
একটি বিশেষ ধরনের টিস্যু, যা একটি প্রাণীর সবধরনের কার্যকারিতার জন্য কাঠামোগত সহায়তা ও চলাচলে সহায়তা প্রদান করে এবং প্রাণীটির শরীরে বিভিন্ন বিপাকীয় প্রক্রিয়া (METABOLISM) সম্পাদন করে। মাংসপেশী অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সংগঠিত বিশেষ ধরনের টিস্যু যা সংকোচনের (CONTRACTION) মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন এবং সরবরাহ করে এবং সেই সংকোচন এর প্রভাব প্রাণীর টেহুন বা লিগামেন্ট এর মাধ্যমে কঙ্কালে প্রেরণ করে। এই প্রক্রিয়ায় মাংসপেশী প্রাণীর চলাচল, বিভিন্ন কাজ কর্মসম্পাদন এবং দেহে শক্তি উৎপাদনে ভূমিকা পালন করে থাকে। মাংস হল মাংসাশী প্রাণীর (CARNIVORE ANIMAL) জন্য খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত উচ্চমানের আমিষ বা প্রোটিন এর একটি উত্তম উৎস। “প্রোটিন” শব্দটি গ্রীক শব্দ “প্রোটিওস” থেকে এসেছে, যার অর্থ “প্রাথমিক বা প্রধান”। এর অর্থ হল, মানুষের সুস্থ্যতার জন্য প্রোটিন একটি প্রয়োজনীয় প্রাথমিক বা প্রধান পুষ্টি উপাদান এবং এই কারণে মাংসাশী প্রাণী হিসেবে মানুষের খাদ্য তালিকায় মাংসের গুরুত্ব অপরিসীম।
মাংসের রাসায়নিক গঠনঃ
বিভিন্ন মাংসের রাসায়নিক গঠন পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, এতে গড়ে শতকরা হারে ৭০-৭৫ ভাগ পানি, ১৯-২৩ ভাগ অপরিশোধিত (CRUDE) আমিষ বা প্রোটিন, ২-৩ ভাগ অপরিশোধিত চর্বি বা ফ্যাট, এবং প্রায় ১ ভাগ খনিজ লবণ (MINERALS) ও শর্করা (CARBOHYDRATE) থাকে ।
ক] মাংসের মূল রাসায়নিক উপাদান হল পানি ঃ
আপনারা উপরে বর্ণিত মাংসের রাসায়নিক গঠন থেকে জেনেছেন যে, মাংস আমাদের খাদ্যে প্রোটিনের বা আমিষের প্রধান উৎস। কিন্তু মাংসে প্রায় চার ভাগের তিনভাগ পানি, ঠিক পৃথিবীর জল আর স্থলভাগের অনুপাতের সমান। মাংসের ওজনের জন্য পানি সবচেয়ে বড় একক অবদানকারী রাসায়নিক উপাদান এবং মাংস রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণরকালে মাংস থেকে মাংসের পানি সহজেই আলাদা হয়ে যায় এবং মাংসের ওজন হ্রাস করে। মাংস রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণের সময় বাড়ার সাথে সাথে মাংস থেকে পানি আলাদা হওয়ার পরিমাণও বাড়তে থাকে। উন্নত বিশ্বে খুচরা বাজারে মাংস বিক্রির সময় মাংসের ট্রেতে মাংসের নীচে শোষক প্যাড দিয়ে রাখে যাতে ক্রেতারা মাংস থেকে বের হয়ে ঝরে যাওয়া পানি দেখতে না পায় (ব্যবসায়ীদের অলিখিত চালাকি)। মাংসের ট্রেতে মাংস থেকে ঝরে যাওয়া পানি দেখে ক্রেতারা মাংস কতটুকু টাটকা (FRESHNESS) চিহ্নিত করতে চেষ্টা করে।
মাংসের আমিষ বা প্রোটিনই মাংসের মধ্যে পানি ধরে রাখার কাজটি করে। মাংসের প্রোটিনের এই ক্ষমতাকে মাংসের জলধারণ ক্ষমতা (WATER HOLDING CAPACITY) হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। মাংসের ভৌত (PHYSICAL) এবং রাসায়নিক গঠনই মাংসের মধ্যে থাকা পানির পরিমাণের সাথে সম্পর্কিত। মাংস বা মাংসপেশীর মধ্যে থাকা জলকে তিনভাবে শ্রেণীবিভক্ত করা হয়, যেমন-
১) মাংসের আবদ্ধ জল (BOUND WATER) :
মাংসের আবদ্ধ জল মাংসে মোট জলের ৪-৫% পরিমাণ মাত্র। এই জল সরাসরি মাংসের মধ্যে অবস্থিত প্রোটিনের সাথে রাসায়নিক বন্ধনের মাধ্যমে খুব দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ থাকে। এই জল মাংস থেকে সহজেই আলাদা হয় না বা আলাদা করা কঠিন। এমনকি মাংসকে ১০০℃ তাপমাত্রায় তাপ দিলে বা মাইনাস ৪০℃ তাপমাত্রায় হিমায়িত করলেও এই জল মাংসের সহিত যুক্তই থাকে। উন্নত বিশ্বে মূলত গরুর মাংস শুকিয়ে বিফজার্কি বানান এবং তার ফলেও এই পানি মাংসের প্রোটিনের সাথেই আবদ্ধ থাকে, মাংস থেকে আলাদা করা যায় না।
২) মাংসেরস্থিত জল বা মাংসের মধ্যে আটকে থাকা জল (IMMOBILIZED WATER/ ENTRAPPED WATER) ঃ
মাংসেস্থিত জলের পরিমাণ মাংসের মোট জলের প্রায় ৭৫-৮০ শতাংশ হয়ে থাকে। এই প্রকার জল মাংসপেশীর গঠনের মধ্যে আটকে থাকে (STERIC EFFECT/ SPACE) এবং মাংসপেশীর মধ্যে অবস্থিত তন্তুগুলি (MYOFILAMENTS) পুকুড়ের পাড়ের ন্যায় কাজ করে জল ধারণ করতে মাংসকে সাহায্য করে। এই জল মাংসের প্রোটিনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত না থেকে বরং পরোক্ষভাবে প্রোটিনের বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত প্রতিক্রিয়াশীল গ্রুপ দ্বারা মাংসের সহিত সংযুক্ত থাকে। পশু জবাইয়ের পরপরই অর্থ্যাৎ পোস্টমর্টেম এর প্রাথমিক পর্যায়ে এই জল মাংসের মধ্যে থেকে বের হয়ে যায় না। তবে মাংসকে কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই জল অপসারণ করা যেতে পারে (যেমন গবেষণায় ব্যবহারের জন্য FREEZE DRYING করার মাধ্যমে এবং হিমায়িত অবস্থায় এই প্রকার জল সহজেই বরফে রূপান্তরিত হতে পারে)। মাংসেরস্থিত জল বা মাংসের মধ্যে আটকে থাকা জল সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় যখন মাংসপেশীতে RIGOR MORTIS প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে মাংসপেশী মাংসে রূপান্তরিত হয়। এর ফলে মাংসপেশীর কোষের (SKELETAL MUSCLE FIBERS) গঠনের পরিবর্তনের কারণে এবং মাংসের pH কমে যাওয়ার ফলে (জীবন্ত প্রাণীর মাংসপেশীর pH ৭.২০ থেকে কমে মাংসে রূপান্তর হওয়ার সময় ৫.৪-৬.০ পর্যন্ত হতে পারে এবং pH কমে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট অংকে স্থির হয়ে যায় যাকে ULTIMATE pH বলা হয়) । মাংসের স্থিত বা মাংসের মধ্যে আটকে থাকা জলের কিছু অংশ মাংস থেকে বের হয়ে যেতে পারে, যাকে ইংরেজীতে PURGE LOSS বলে। মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় যতবেশি জল মাংসে স্থিত অবস্থায় থাকে, তা প্রক্রিয়াজাতকরণ মাংসজাত পণ্যটির জল বা আর্দ্রতা ধরে রাখার ক্ষমতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে মাংসের যত বেশি জল ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে, সেই প্রক্রিয়াজাত মাংস ততবেশী পরিমান জল ধারণ করে উৎপাদিত পণ্যের পরিমাণ বাড়ায়। ধরুন, আপনি ১ কেজি পরিমাণ দুই ধরণের মাংস নিয়ে বার্গার এর চপ বানাচ্ছেন। এক ধরনের মাংস যদি অপরটির তুলনায় ১০০ গ্রাম জল বেশী ধারণ করতে পারে, তাহলে ওই গ্রুপের চপ অন্য গ্রুপের তুলনায় ১০০ গ্রাম বেশী চপ উৎপাদন করবে। তাই মাংসের জল ধারণ ক্ষমতা কম হলে, ব্যবসায়ীরা অনেক লোকসান দেন বা মাংসের দাম বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হন।
৩) মাংসের মুক্তজল (FREE WATER)ঃ
মাংসপেশীর কোষের মেমব্রেন এবং “কৈশিকক্রিয়া” (CAPILLARY ACTION) দ্বারা এই জল মাংস ধারণ করে। মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় যেমন যখন মাংস চুর্ণ (GRIND) বা পেষণ করা হয় তখন মাংসপেশীর কোষের মেমব্রেন (যা মাংসের মুক্ত জল ধরে রাখার জন্য বেষ্টনী হিসেবে LAKE বা DAM এর পাড়ের ন্যায় কাজ করে) ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে মাংস এই মুক্তজল ধরে রাখতে পারে না। খুচরা বিক্রয়ের জন্য যখন মাংস ছোট করে কাটা হয় তখন মাংসপেশীর কোষের মেম্ব্রেন ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার ফলে মাংসের মুক্তজল খুব সহজেই মাংস থেকে বের হয়ে যায়, যাকে মাংসবিজ্ঞানের ভাষায় মাংসের জল ঝরা (DRIP LOSS) বলা যায় । মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় যদি মাংসের এই মুক্তজলকে স্থিত অবস্থায় রূপান্তর করা যায়, তবে মাংস থেকে জল ঝরা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং মাংসের ওজন ও মান নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাংসে মুক্তজলের পরিমাণ মাংসের মোট জলের প্রায় ১০-১৫ শতাংশ হয়ে থাকে।
এখন আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে কৈশিকক্রিয়া (CAPILLARY ACTION) কি, তা একটু ব্যাখ্যা করতে চাই। কৈশিকক্রিয়া হলো একটি প্রক্রিয়া যখন কোন তরল পদার্থ (যেমনজল) একটি খুব সরু নল বা ছিদ্রযুক্ত কোন পদার্থের মধ্যে দিয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রবাহিত হয়। এই ক্ষেত্রে তরল পদার্থের প্রবাহের জন্য মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রয়োজন হয় না (যেমন প্রাকৃতিকভাবে নদীর জল সবসময় মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে নীচের দিকে ধাবিত হয়), বরং প্রায়শই কৈশিকক্রিয়া প্রক্রিয়াটি মাধ্যাকর্ষণ বলের বিপরীতে কাজ করে। এর সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হলো উদ্ভিদের শেকড় থেকে পাতায় পানি পৌছানোর প্রক্রিয়াটি। উদ্ভিদের জাইলেম হলো শেকড় থেকে পাতায় পানি পরিবহনের মাধ্যম। এই জাইলেম উদ্ভিদের শেকড় থেকে কান্ড হয়ে পাতায় পানি পরিবহনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। যে কোন গাছের গুড়ি আড়াআড়িভাবে কাটলে যে রিং বা চক্র দেখা যায় তাই জাইলেম। জাইলেম টিস্যু এক বছর পর এর কার্যকারিতা হারায় এবং পুরাতন ও নতুন জাইলেম এর মধ্যে একটি রিং বা চক্র তৈরী করে। এইসব চক্র দেখে অনেক ক্ষেত্রে গাছের বয়স নির্ধারণ করা হয়। জাইলেম হলো সেলুলোজের তৈরি লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্রনল। পানির অণুগুলো আবার একসাথে লেগে থাকতে পছন্দ করে (যাকে ইংরেজীতে COHESION বলে)। পাশাপাশি দু-ফোটা পানি একটি মসৃণ সমতলের উপর নিয়ে কাঠি দিয়ে একফোটা থেকে অন্য ফোটাতে টান মারেন, দেখেন তারা একে অপরকে কত পছন্দ করে, কত ভালবাসে এবং একে অপরকে জড়িয়ে ধরে- এটাকে পানির COHESION বলে এবং আপনি নিজেই তা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন । পানির অণুগুলো গাছের জাইলেমের সেলুলোজের সরু নলের দেয়ালে লেগে থাকতে পছন্দ করে (যাকে ইংরেজীতে ADHESION বলে)। এইসব বৈশিষ্টের কারণে পানি গাছের শিকড় থেকে সেলুলোজের অতি সরু নলের সাহায্যে উপরে মাধ্যাকর্ষণ বলের (GRAVITY FORCE) বিপরীতে ও পাতা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। প্রাণীর মাংসপেশীতে মাংসপেশীর তন্তুগুলি (MYOFIBRILS) নলের মত অবয়ব তৈরী করে যা মাংসে পানির COHESION এবং ADHESION ক্রিয়া সম্পাদনে ভূমিকা পালন করে।
খ] মাংসে আমিষ বা প্রোটিনঃ
মাংসপেশীর প্রোটিনগুলি মাংসপেশীর ফাইবারের গঠনের অবস্থান, ভৌত রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য (মূলত প্রোটিনের দ্রবণীয়তা) এবং মাংসের আরও প্রক্রিয়াকরণের কার্যকারিতার ভিত্তিতে ভাগ করা যেতে পারে। মাংসপেশীর প্রোটিনগুলি প্রোটিনের তিনটি বড় গ্রুপ গঠন করে।
১) মায়োফাইব্রিলার প্রোটিন (MYOFIBRILLAR PROTEIN):
এই প্রোটিন মাংসের মোট প্রোটিনের ৫০-৬০%। এই প্রোটিন লবণের দ্রবণে দ্রবণীয় অর্থ্যাৎ লবণের দ্রবণে মাংস চুবিয়ে রাখলে বা ভিজিয়ে রাখলে মায়োফাইব্রিলার প্রোটিন মাংস থেকে লবণ দ্রবণে দ্রবীভূত হয় এবং মাংস থেকে নিষ্কাশন করা যায়। মাংস দিয়ে প্রক্রিয়াজাত মাংস জাত দ্রব্য বানানোর ক্ষেত্রে মাংসে লবণ মেশানো হয় যাতে মায়োফাইব্রিলার প্রোটিনের প্রধান প্রোটিন মায়োসিন এবং অ্যাক্টিন নিষ্কাশন করা যায়।
এই প্রকার প্রোটিনমূলত মায়োসিন, অ্যাক্টিন, ট্রপোমায়োসিন, এম-প্রোটিন, আলফা-অ্যাক্টিনিন, বিটা-অ্যাক্টিনিন, সি-প্রোটিন, ট্রপোনিনটি, আই, এবং সি এবং সেই সাথে মায়োফিব্রিলের সাথে যুক্ত অন্যান্য ছোট খাট প্রোটিন নিয়ে গঠিত। মায়োসিন এবং অ্যাক্টিন একসাথে মোট মাংসপেশী প্রোটিনের ৬৫%; ট্রপোমায়োসিন এবং ট্রপোনিন প্রতিটি অতিরিক্ত ৫% এবং অবশিষ্ট ২৫% অন্যান্য নিয়ন্ত্রক এবং কাঠামোগত প্রোটিন দ্বারা গঠিত। মায়োফাইব্রিলার প্রোটিন প্রধানত মায়োসিন এবং অ্যাক্টিন নিরপেক্ষ লবণের দ্রবণে দ্রবণীয় হওয়ার কারণে মায়োফাইব্রিলার প্রোটিন “লবণ-দ্রবণীয় প্রোটিন (SALT SOLUBLE)” নামেও পরিচিত।
২) সারকোপ্লাজমিক প্রোটিন (SARCOPLASMIC PROTEIN) ঃ
সারকোপ্লাজমিক প্রোটিন হল মোট মাংসপেশী প্রোটিনের ২৫-৩০%। এই মাংস প্রোটিন পানিতে দ্রবণীয় হয়। সারকোপ্লাজমিক প্রোটিন মূলত মায়োগ্লোবিন, হিমোগ্লোবিন, সাইটোক্রোম প্রোটিন এবং বিভিন্ন ধরণের এন্ডোজেনাস এনজাইম নিয়ে গঠিত। সারকোপ্লাজমিক প্রোটিন পানিতে দ্রবণীয় এবং লবণের খুব কম ঘনত্বের দ্রবণেও দ্রবণীয়। যেহেতু এই প্রোটিনগুলি বিশুদ্ধ জল দিয়ে মাংস থেকে নিষ্কাশন করা যায়, তাই “জল-দ্রবণীয় প্রোটিন” নামটি এই প্রোটিনের ক্ষেত্রে প্রচলিত হয়ে উঠেছে। মায়োগ্লোবিন সম্ভবত সারকোপ্লাজমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন কারণ এটি মাংসের রং এর জন্য দায়ী, যা মাংসের গুণগত মানের সাথে জড়িত। আর সেজন্যই আপনারা মাংস কিনতে গেলে মাংসের রং দেখে বুঝতে চেষ্টা করেন যে সেটা কতটা টাটকা (FRESH)। মায়োগ্লোবিনে একটি গ্লোবুলার প্রোটিন অংশ (গ্লোবিন) এবং একটি নন-প্রোটিন অংশ থাকে, যাকে হিম (HEME) রিং বলা হয়। মায়োগ্লোবিন রঞ্জকটির HEME অংশটি HEME রিংয়ের মধ্যে লোহার বা আয়রণের (IRON) অক্সিডেশন অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং মাংসের রং পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৩) কানেকটিভ টিস্যু প্রোটিন বা সংযোগকারী টিস্যু প্রোটিন বা স্ট্রোমাল প্রোটিনঃ
মাংসের মোট প্রোটিনের ১০-২০% কানেকটিভ টিস্যু প্রোটিন বা সংযোগকারী টিস্যু প্রোটিন বা স্ট্রোমাল প্রোটিন [পানিতে বা লবণের দ্রবণে দ্রবণীয় নয়, তবে ফুটন্ত গরম পানিতে আংশিক এবং এসিড বা ক্ষারের দ্রবণে দ্রবণীয়। কানেকটিভ টিস্যু প্রোটিন বা সংযোগকারী টিস্যু প্রোটিন বা স্ট্রোমাল প্রোটিন প্রাথমিকভাবে কোলাজেন এবং ইলাস্টিন নামক প্রোটিন নিয়ে গঠিত। কোলাজেন হল একক সর্বাধিক প্রোটিন যা প্রাণীর শরীরে পাওয়া যায় এবং যা মূলত হাড়, ত্বক, টেন্ডন, তরুণাস্থি এবং পেশীতে উপস্থিত থাকে। এই কোলাজেন নামক প্রোটিনকে পানিতে তাপ দিলেই কিছু পরিমাণ কোলাজেন DENATURE হয়ে পানিতে দ্রবণীয় হয়ে যায়। এইপানি রেফ্রিজারেশন তাপমাত্রায় রেখে দিলে তা জমে যায়, যা আসলে জেলাটিন। সারকোপ্লাজমিক রেটিকুলামসহ কোষের ঝিল্লির কোলাজেন, ইলাস্টিন এবং লাইপো প্রোটিনগুলি মাংসপেশীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী টিস্যু প্রোটিন। মাংসপেশীতে, সংযোজক বা সংযোগকারী টিস্যু প্রধানত কোলাজেন নামক প্রোটিন দ্বারা গঠিত এবং মাংসপেশির কোষ বা ফাইবারের জন্য EXTRACELLULAR MATRIX হিসাবে কাজ করে।
মাংসের প্রোটিনের এই দ্রবনীয়তা প্রক্রিয়াজাত মাংস দ্রব্য প্রস্ততকরণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে বিধায় যে বা যাহারা প্রক্রিয়াজাত মাংস নিয়ে কাজ করেন তাঁদের জানা থাকা ভাল।
গ] মাংসে চর্বি বা ফ্যাটঃ
চর্বি বা ফ্যাট মাংসের সবচেয়ে পরিবর্তনশীল উপাদানগুলির মধ্যে একটি। চর্বি বা ফ্যাট হল খুব উচ্চ শক্তির যৌগ এবং শুধুমাত্র ক্যালোরিইনয়, INTRAMUSCULAR ফ্যাট মাংসের স্বাদ, রসালতা (JUICINESS) এবং গঠন বা বুননে (TEXTURE) অপরিসীম অবদান রাখে। INTRAMUSCULAR ফ্যাট এর পরিমাণ মাংসে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হতে পারে। বলা হয় যে, বিভিন্ন প্রজাতির মাংসের মধ্যে স্বাদের যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তা প্রতিটি প্রজাতির মাংসের চর্বি বা ফ্যাটের বিন্যাসের বিভিন্নতার কারণে হয়ে থাকে। INTRAMUSCULAR ফ্যাটকে MARBLING ও বলা হয় এবং অনেক উন্নত দেশে প্রধানত গরুর মাংসের ক্ষেত্রে মাংস গ্রেডিং এর জন্য ব্যবহৃত হয় ।
ঘ] মাংসে খনিজ পদার্থ ঃ
মাংস আমাদের শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ খনিজ পদার্থের একটি উৎস। মাংসে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্লোরিন, ফসফরাস, আয়রণ, ক্যালসিয়াম, সালফার ইত্যাদি খনিজ উপাদান থাকে। মাংস আমাদের মানব শরীরের জন্য আয়রণের একটি খুব ভালো উৎস । কারণ ১০০ গ্রাম রান্না করা মাংস আমাদের শরীরে মোট প্রয়োজনের শতকরা ৩৫% আয়রণের যোগান দিতে পারে। মাংসপেশীতে আয়রণ মূলত হিমোগ্লোবিন, মায়োগ্লোবিন এবং বিভিন্ন ধরণের এনজাইম এর গাঠনিক উপাদান হিসেবে থাকে।
ঙ] মাংসে কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা ঃ
যদিও শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট সামগ্রিকভাবে মাংসের মধ্যে একটি অতি নগন্য রাসায়নিক উপাদান। তবে এটি পশু জবাইয়ের পর মাংসপেশী থেকে মাংস রূপান্তরের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাংসের প্রধান কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা হল গ্লাইকোজেন (যা গ্লুকোজের পলিমার)। গ্লাইকোজেন মূলত মাংসপেশী এবং লিভারে থাকে। গবাদীপশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য খাওয়ানো হলে তাঁর লিভারের প্রতি গ্রাম টিস্যুতে ৫০ মিলিগ্রাম এবং মাংসপেশীর প্রতি গ্রামে ১০-২০ মিলিগ্রাম গ্লাইকোজেন থাকে। আধুনিক জবাইখানায় গবাদীপশু জবাই করার ১২-২৪ ঘন্টা আগে থেকে খাদ্য খেতে দেয়া হয় না । এই উপবাস পর্যায়ে লিভারে জমাকৃত গ্লাইকোজেন ভেঙে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ প্রয়োজনীয় স্তরে বজায় রাখতে চেষ্টা করে এবং এই প্রক্রিয়াকে “হোমিওস্টেসিস” এর একটি অংশ বলে ধরা যায়। “হোমিওস্টেসিস” সম্পর্কে এই লিখনির শেষ অংশে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। পশু জবাইয়ের পর অ্যানেরোবিক অবস্থায়, মাংসপেশীর গ্লাইকোজেন মাংসপেশী সংকোচনের জন্য শক্তি উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয় এবং গ্লাইকোজেন ভেঙ্গে ল্যাকটিক অ্যাসিডে পরিণত হয়। পশু জবাইয়ের পর পোস্টমর্টেম এ যে সকল পরিবর্তন হয় এবং RIGOR MORTIS শুরু এবং শেষ হওয়া নির্ভর করে পশু জবাইয়ের পূর্বে পশুর মাংসপেশীতে গ্লাইকোজেন এর পরিমাণের উপর।
“হোমিওস্টেসিস” কি এবং প্রাণীর শরীরে “হোমিওস্টেসিস” নিয়ন্ত্রিত হয়?
“হোমিওস্টেসিস’ (HOMEOSTASIS) হল যে কোন পারিপার্শ্বিক পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রাণী ইহার শরীরে শারীরবৃত্তীয়ভাবে ভারসাম্য রক্ষার্থে শরীরের অভ্যন্তীণ পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষণের যে চেষ্টা চলে বা করে তাকেই বোঝায়। মাংসপেশী থেকে মাংসে রূপান্তরের সময় যে সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটে তা ভালভাবে বোঝার জন্য “হোমিওস্টেসিস” সমন্ধে খুব ভাল ধারণা থাকা দরকার। প্রাণী দেহে জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন “হোমিওস্টেসিসের” সরাসরি ফলাফল। আপনি কখনও কিভেবে দেখেছেন, সুস্থ অবস্থায় আমাদের শরীরের তাপমাত্রা সবসময় স্থির থাকে কেন? তা গরম হোক বা শীত হোক? এই হোমিওস্টেসিসের কারণেই প্রাণীর শরীর বাহ্যিক পরিবেশের তাপমাত্রা বা অন্য যে কোন পরিবর্তনের সাথে সাথে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে, তা অধিক শীত হোক বা অধিক গরম হোক। প্রাণীদেহের অভ্যন্তরীণ এবং ইহার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্রমাগত ইহার শরীরে “স্থিত অবস্থা” (HOMEOSTASIS-হোমিওস্টেসিস) নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামঞ্জস্য রক্ষা করে বেঁচে থাকে। প্রাণীদেহের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের নির্দেশক (PARAMETERS) যেমন pH, তাপমাত্রা এবং শক্তি সরবরাহের জন্য অক্সিজেন ঘনত্ব একটি স্বল্প পরিসরের (RANGE) মধ্যে থাকলেই একটি প্রাণীর মাংসপেশী এবং ইহার দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে। কখনও কখনও প্রতিকূল পরিবেশেও হোমিওস্টেসিস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রাণীটি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। জবাইকৃত প্রাণীর ক্ষেত্রে শরীর থেকে সব রক্ত বের হয়ে গেলে (যাকে ইংরেজীতে EXSANGUINATION বলে), প্রাণীর শরীরেও সমস্ত হোমিওস্ট্যাটিক প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। EXSANGUINATION এরপর মাত্র ৪ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে প্রাণী তাঁর কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে স্নায়ুবিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। মাংসপেশী হলো ঐচ্ছিক (VOLUNTARY) পেশী এবং সে জন্য এর প্রতিটি কোষ স্নায়ুতন্ত্রের সাথে সংযুক্ত থাকে যাতে প্রাণী তাঁর প্রয়োজনের সময় যেকোন মূহুর্তে সিগন্যাল দিয়ে উদ্দীপনা সৃষ্টির মাধ্যমে কাজ করতে পারে। যার ফলে প্রাণী তার ইচ্ছা অনুযায়ী স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে সিগন্যাল পাঠিয়ে মাংসপেশী নড়াচড়া করতে পারে। মাংসপেশী স্নায়ুতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর একটি উল্লেখযোগ্য সময় মাংসপেশীতে অনিয়ন্ত্রিত সংকোচন-প্রসারণ সংগঠিত হয়। শরীরের তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য যে “হোমিওস্টেসিস” ব্যবস্থা শরীরে ছিল তা ইতিমধ্যে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আস্তে আস্তে জবাইকৃত প্রাণীর শরীরের তাপমাত্রাও কমতে শুরু করে।
লেখক ঃ বিমল চন্দ্র রায়, পিএইচডি (জাপান), পোস্টডকটোরালফেলো (জাপান, ক্যানাডা)
বর্তমানে গবেষণা সহযোগী, ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টা, এডমন্টন, আলবার্টা, ক্যানাডা (CARCASS AND MEAT SCIENCE LABORATORY)