২ আগস্ট ২০২৩, সিলেট: বিগত বছর গুলোতে সিলেট বিভাগে পুষ্টিসূচকের যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে,তবে দুধ উৎপাদনে এখনও অনেকটাই পিছিয়ে। এদিকে সারা দেশে পুষ্টি ও প্রোটিন বিষয়ক জনসচেতনতা বাড়াতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রচুর কাজ হলেও এখনও সাধারণ মানুষের মাঝে তথ্য ও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আছে ভুল ধারণা ও কুসংস্কার। তাই সরকার ঘোষিত পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যবান ও মেধাবি জাতি গঠন করতে হলে -পুষ্টি বিষয় কপ্রচার-প্রচারণায় স্কুলের শিক্ষক ও মসজিদের ইমামদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করতে হবে। আজ সিলেট শহরে অনুষ্ঠিত “রাইটটু প্রোটিন” শীর্ষক সেমিনারে পুষ্টি বিশেষজ্ঞ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মসজিদের ইমামগণ এ মতামত তুলে ধরেন। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এবং ইউ.এস. সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউ.এস.এস.ই.সি) যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. মারুফ হাসান বলেন, বিগত বছর গুলোতে সিলেটে পুষ্টিসূচকের যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে। বর্তমানে সিলেট বিভাগে বছরে ১১৪.৭৬ কোটি চাহিদার বিপরীতে ডিম উৎপাদিত হচ্ছে ১৩৮.৪৩ কোটি অর্থাৎ উদ্বৃত্ত থাকছে প্রায় ২৩.৬৬ কোটি পিস। অন্য দিকে ৪.৮৩ লক্ষ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে মাংস উৎপাদিত হচ্ছে ৫.২৫ লক্ষ মেট্রিক টন। তবে দুধের উৎপাদন এখনও আশা ব্যঞ্জক নয়। ১০.০৬ লক্ষ মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে দুধ উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ৭.০৫ লক্ষ মেট্রিক টন, অর্থাৎ ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৩.০১ লক্ষ মেট্রিক টন।
সিলেট সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার, ডা. ¯িস্নগ্ধা তালুকদার বলেন, সিলেটে বহুজাতি গোষ্ঠীর বসবাস। সরকারের কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণে বেসরকারি সংস্থা গুলোকে সাথে নিয়ে কাজ করছে সিলেট সিভিল সার্জন কার্যালয়। তিনি বলেন, সরকার পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের বিষয়টিকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি ২০২০ প্রণয়ন করেছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশু, কিশোর-কিশোরী ও সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী এবং গর্ভধারণ ক্ষম, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারি নারীদের অপুষ্টি হ্রাসে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এছাড়াও “জীবনের প্রথম ১০০০ দিনের পুষ্টি কর্মক্রম” সম্প্রাসরণের উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন কালে বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের প্রধান পুষ্টিবিদ- শামসুন্নাহার নাহিদ মহুয়া বলেন, অপুষ্টির কারণে বাচ্চাদের ওজন ও উচ্চতা কম হয়; মা ও শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ে, বাড়ন্ত বয়সের কিশোর কিশোরীদের নানাবিধ শারিরিক ও মানসিক জটিলতা দেখা দেয়। সবচেয়ে ভয়ানক বিষয়টি হচ্ছে- অপুষ্টি’র প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। তাই উন্নত দেশ ও জাতি গড়তে হলে আমাদেরকে অপুষ্টির অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতেই হবে। মহুয়া বলেন, মূল্য বৃদ্ধির এ বাজারে এখনও পোল্ট্রি’র ডিম ও ব্রয়লার মুরগি হচ্ছে সবচেয়ে সস্তার প্রাণিজ আমিষ। তাঁর মতে,স্কুলের পাঠ্যক্রমে প্রোটিন বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলো এখনও অনুপস্থিত। ফলে শিশুদের মাঝে প্রোটিন বা পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছেনা। তিনি বলেন, প্রোটিন ঘাটতির কারণে নানাবিধ রোগ ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল প্রজননক্ষম মানুষের মাঝে ইনফারলিটির সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। মহুয়া বলেন, পুষ্টি ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ প্রতি বছরে প্রায় ১০৭২ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে।
বিপিআইসিসি সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন- করোনা মহামারির সময় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে, টিকা নিতে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে, ডায়াবেটিস ও যক্ষা বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে, মাদকের বিরুদ্ধে, এমনকি জঙ্গীবাদ দমনেও মসজিদের ইমামদের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। জুম্মা’র খুৎবায় প্রোটিন ও পুষ্টি বিষয়ে ইমামগণ কথা বললে সমাজের মানুষ উপকৃত হবে, সরকারের পক্ষে পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজতর হবে। খালেদ আরওবলেন, শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের কারণেই আধুনিক সমাজ আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছে। তাঁরাই পারেন শিক্ষার্থীদের পুষ্টি ও প্রোটিন বিষয়ে সঠিক শিক্ষা দিতে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের দেশের জনসংখ্যা ১৮৬ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে তাই কাঙ্কিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে এবং সাশ্রয়ী দামে প্রোটিনের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। বিপিআইসিসি সভাপতিবলেন, উন্নয়ন বলতে এক সময় কেবল মাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই বোঝানো হতো কিন্তু এখন উন্নয়ন বলতে Nutrition Sensitive Economic Growth কে বোঝানো হয় । কাজেই শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেই চলবে না, পুষ্টিসূচকেও উন্নতি লাভ করতে হবে।
ইউএসসয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া এন্ড সাব সাহারা অঞ্চলের হেড অব মার্কেটিং দি বাইয়ানুলিস এক ভিডিও বার্তায় বলেন, এসডিজি’তে ক্ষুধা মুক্ত সমাজ গঠনের উপর জোর দেয়া হয়েছে। তবে শুধু খাদ্য গ্রহণ করলেই হবে না; খাদ্যকে হতে হবে পুষ্টিকর ও নিরাপদ। তিনি বলেন,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ^ সেরা সয়াবিন উৎপাদন করছে এবং তা বিশে^র বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। এই সয়াবিন উদ্ভিজ্জ প্রোটিন হিসেবে মানুষ গ্রহণ করছে আবার উদ্ভিজ্জ প্রোটিনকে প্রাণিজ প্রোটিনে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। দিবা বলেন, প্রোটিন সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ভুল ধারণা রয়েছে যা দূর করতে ইউএসএসইসি এবং বিপিআইসিসি যৌথ ভাবে কাজ করছে।
ইউএসএসইসি'র বাংলাদেশ টীমলিড খবিবুর রহমান (কাঞ্চন) বলেন- কম সময়ে, স্বল্প জমি ব্যবহার করে এবং পরিবেশের ক্ষতি না করে কিভাবে প্রোটিনের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়ে কাজ করছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। “আমরা মৎস্য ও প্রাণি খাদ্য তৈরিতে সয়াবিন ও সয়াবিনমিল সরবরাহ করছি। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশে আই পি আর এস প্রযুক্তির প্রচলন করেছি। শুধু তাই নয় ক্যাটল ও ডেইরি প্রজেক্টের জন্যও অচিরেই কার্যকর সল্যুশন নিয়ে আসছে ইউএসএসইসি।”
ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স এসোসিয়েশন- বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সাধারণ সম্পাদক মো. মাহাবুব হাসান বলেন, প্রোটিন কনজাম্পশন বাড়ার কারণে বাংলাদেশের মানুষের আয়ুষ্কাল বেড়েছে। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা লম্বা হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ম্যাথ অলিম্পিয়াড সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সফলতার স্বাক্ষর রাখছে।
সেমিনারে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি, এনিমেল এন্ড বায়ো কেমিক্যাল সায়েন্সেস এর ডীন প্রফেসর ড. মো. রাশেদ হাসনাত। অন্যান্যো মাঝে বক্তব্য রাখেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর সিলেট বিভাগীয় পরিচালক মো. মহিউদ্দীন, সিলেট প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) এর সুপার ইনটেনটেন্ড এ.কে.এম সাইফুল হাসান, জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর কবির, বিপিআইসিসি’র যোগাযোগ ও মিডিয়া উপদেষ্টা মোঃ সাজ্জাদ হোসেন প্রমুখ। সেমিনারে স্কুল শিক্ষক ও ইমামসহ মোট ১৫০ জন অংশগ্রহণ করেন।