"মাংসের বাজারে প্রাণী জবাই থেকে ভোজন অবধি খাদ্য নিরাপত্তায় যে স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি" - আর এস মাহমুদ হাসান

অতিথি আপ্যায়নে মাংস বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে আপ্যায়নে রেড মিট বা লাল মাংস নামে পরিচিত গরু, ছাগলের মাংসের চাহিদা প্রচুর। কিন্তু এই মাংস যেখানে প্রক্রিয়াজাত বা প্রাণী জবাই করা হয় সেই কসাইখানার পরিবেশটা নিয়েই বা ভাবে কয়জন ক্রেতা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি এন্ড হাইজিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ গোলজার হোসেনের ফুড মাইক্রোবায়োলজি এন্ড হাইজিন কোর্সের ফিল্ড ওয়ার্কের দরুণ দেশের গরু ছাগলের মাংসের বাজার পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছিল। আজ কসাইখানায় প্রাণী জবাই থেকে শুরু করে মাংস বিক্রি এবং সেটা ভোজন অবধি যে ত্রুটির মধ্য দিয়ে

আমরা যাই সেটা ও তার সমাধান প্রসঙ্গে আলোচনা করব।
মফস্বল বা জেলা শহরের মাংসের লোকাল বাজার গুলোতে প্রবেশ করলেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গরু, ছাগল জবাই এবং মাংস প্রস্তুত করা হচ্ছে তা যে কারোই চোখে পড়বে। যেখানে গরু, ছাগল জবাই করা হচ্ছে সেই স্থানের পাশেই নোংরা পরিবেশ, জবাইয়ের স্থানে কুকুরের রক্ত চেটে খাওয়ার দৃশ্যও সহজে চোখে পড়ে। কসাই ও তার সহযোগীদের পায়ে দেখা যায় জুতা, সেই জুতা পায়েই তাদের জবাইয়ের মেঝেতে মাংস কাটতে ও পাশের নোংরা পরিবেশে হাঁটাচলা করতে দেখা যায়।
কসাইখানা থেকে মাংস কেটে খোলামেলা ভাবে ভ্যানে করে মাংস নিয়ে যাওয়া হয় বিক্রির স্থানে, মাংসের উপরে বা নিচে দেখতে পাওয়া যায়না কোন কাগজ বা পলিথিন। যখন ক্রেতাকে মাংস দেয়া হয় মাছির ভনভন শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা। এরপর সারাদিন মাংস বিক্রির পর অবশিষ্ট মাংসগুলো সংরক্ষণ করা হয় ফ্রীজে। যার মাধ্যমে ক্রেতার কাছে বাসি পচা মাংস যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
এই যে মাংসের বাজারের এত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এর মাধ্যমে নানান রোগ ক্রেতার কাছে ভীড়তে পারে। যেমন- কুকুরের লালা থেকে জলতাঙ্ক, রিংওয়ার্ম, মাছি থেকে পেট ব্যাথা, কলেরা, আমাশয়, কৃমি, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়। এছাড়া হিমায়িত মাংসের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়, এর মাধ্যমে অহরহ ঘটে ফুড পয়জনিং।

জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মানসম্পন্ন মাংস পেতে করণীয়ঃ
পশু জবাই ও মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০২১ অনুযায়ী -

  • জবাইয়ের পূর্বে ভেটেরিনারি কর্মকর্তা বা ভেটেরিনারিয়ান কর্তৃক প্রাণীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
  • কোনো প্রাণী জবাই করতে হইলে উক্ত প্রাণী সুস্থ ও জীবিত হতে হবে।
  • জবাইয়ের পূর্বে প্রাণীকে পর্যাপ্ত বিশ্রামে রাখতে হবে, জবাইয়ের ১২ ঘণ্টা পূর্ব পর্যন্ত পরিষ্কার পানি ছাড়া অন্য কোন খাবার খাওয়ানো যাবে না।
  • জবাইয়ের পূর্বে প্রাণীর শরীর ভালভাবে পরিষ্কার করতে হবে, যেন শরীরে কোনো ময়লা বা মলমূত্র লেগে না থাকে।
  • কোনো অবস্থাতেই একটি প্রাণীর সামনে অন্য প্রাণী জবাই করা যাবে না।
  • জবাইয়ের পূর্বে প্রাণী উত্তেজিত হয়ে পড়লে শান্ত করার জন্য ভেটেরিনারি কর্মকর্তা বা ভেটেরিনারিয়ানের তত্ত্বাবধানে উক্ত প্রাণীকে পৃথক স্থানে রেখে পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রদানের মাধ্যমে শান্ত করতে হইবে এবং উক্ত প্রাণীটি শান্ত হইলে তারপর জবাই করতে হবে।
  • কসাইখানা বা জবাইখানাতে জবাইয়ের পর বর্জ্য অপসারণ জরুরি। প্রাণীর নির্গত রক্ত বা ধৌত করা পানি ও অন্যান্য তরল বর্জ্য সহজেই অপসারণের জন্য পৃথক নালাসহ নির্দিষ্টকৃত গর্তের দিকে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা এবং নিরাপদ দূরত্বে নির্মিত গর্তে ফেলে মাটি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
  • জবাইয়ের জন্য প্রাণীর নূণ্যতম বয়স (মাস হিসেবে) - গরু ও মহিষ ৮ মাস, ছাগল ও ভেড়া ৫ মাস, দুম্বা ৬ মাস, খরগোশ ৩ মাস, উট ১২ মাস।
  • দুগ্ধবতী প্রাণী, দুগ্ধদানকাল (অনধিক, মাস হিসাবে) জবাই থেকে বিরত থাকতে হবে-  গরু ও মহিষ ৭ মাস, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা ৩ মাস, খরগোশ ২ মাস, উট ৬ মাস।
      
    মাংসের হাইজিন ব্যবস্থাপনাঃ
  • জবাই এবং মাংস প্রোসেসের সময় সঠিক পদ্ধতিতে গ্লাভস, মাস্ক, হেয়ার নেট ব্যবহার করতে হবে। ধুলোবালি মুক্ত পরিবেশে মাংস প্রসেস করা এবং প্রসেসের সময় পর্যাপ্ত পানি ব্যবহার করা যাতে মাংসের মধ্যে কোন রকম রক্ত না থাকে, এতে মাংসের মধ্যে জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
  • স্বাদ এবং গুণগত মান ঠিক রাখতে প্রতি দিনের মাংস প্রতিদিনই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে।
  • কাঁচা মাংস বাজারের ব্যাগে ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। তাই বাজারের ব্যাগগুলিকে নিয়মিত ভাল করে ধুয়ে ফেলতে হবে। জীবাণুমুক্ততা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। মাংস বিষাক্ত হতে পারে এতে থাকা ব্যাকটেরিয়ার কারণে কিংবা ব্যাকটেরিয়া থেকে উৎপন্ন বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার কারণে। এছাড়া ভাইরাস এবং প্যারাসাইট বা পরজীবীর কারণেও খাদ্যে বিষক্রিয়া হতে পারে। কাঁচা মাংস থেকে ক্যাম্পাইলোব্যাকটার ব্যাকটেরিয়া, ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া, সালমোনেলা প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।
  • সব ধরণের মাংসে ব্যাকটেরিয়া থাকে বিধায় সেগুলো সঠিকভাবে প্রস্তুত করা এবং ভালভাবে রান্না করাটা জরুরি। রান্না করার আগে মাংস ধোয়া নিয়েও সতর্ক থাকতে হবে কারণ এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া অন্য খাবারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভালভাবে সিদ্ধ করে রান্না করা হলে সব ধরণের ব্যাকটেরিয়া মারা যায়।
  • মাংসের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে হ্যাজার্ড এনালাইসিস এন্ড ক্রিটিকাল কন্ট্রোল পয়েন্ট (এইচ.এ.সি.সি.পি) ব্যবস্থা চালু করা।

    অবশিষ্ট মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণের উপায়ঃ
  • মাংস বিক্রির পর বিক্রেতাকে অবশিষ্ট মাংস বা বাসায় কেনার পর ভোক্তাকে সুন্দর উপায়ে মাংস সংরক্ষণ করতে হবে। জমে থাকা রক্ত ও ময়লা থেকে জীবাণু মাংসের স্বাদ ও গুণাগুণ দুটোই নষ্ট করে দিতে পারে। তাই ফ্রিজের পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত জরুরি।
  • মাংস সংরক্ষণের আগে ভালোভাবে ধুয়ে রক্ত পরিষ্কার করে নিতে হবে। কারণ মাংসে রক্ত লেগে থাকলে মাংস পচে যেতে পারে। মাংস বড় চালনিতে রেখে মাংসের পানি ঝরিয়ে ফ্যানের নিচে শুকাতে হবে। পানি ঝরে গেলে পলিথিনের প্যাকেটে ভরে মাংস ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন।
  • মাংস ধুতে না চাইলে পরিষ্কার টিস্যু বা শুকনা কাপড় দিয়ে মাংসের গায়ে লেগে থাকা রক্ত ভালমতো মুছে পলিথিনে করে ফ্রিজে মাংস সংরক্ষণ করতে হবে।
    খাদ্যে যেভাবে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ঃ
    যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং বিবিসির গুডফুডের প্রতিবেদন অনুযায়ী-
  • খাদ্য ভালভাবে রান্না না করা বা মাংস ভালভাবে সিদ্ধ করা না হলে।
  • খাবার তৈরি বা পরিবহন বা সরবরাহের সময় হাত ভাল করে না ধুলে। বিশেষ করে টয়লেট ব্যবহারের পর কিংবা ময়লা ফেলার পর সাবান দিয়ে দিয়ে হাত না ধুলে।
  • রান্না করা খাবার দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ না করলে কিংবা ফ্রিজে সঠিকভাবে না রাখলে।
  • খাবার নির্ধারিত সময়ের পরও ব্যবহার করলে।
  • অসুস্থ কারো স্পর্শ করা খাবার খেলে বা এমন কোন ব্যক্তির স্পর্শ করা খাবার খেলে যে অসুস্থ কারো সংস্পর্শে গিয়েছিল।
  • ক্রস কন্টামিনেশন বা যেখানে এক খাবার থেকে আরেক খাবারে কিংবা খাবার সরবরাহের পাত্র থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ভালো খাবারে ছড়িয়ে পড়ে। যেমন- কোন চপিং বোর্ড, ছুরি বা বঁটি ব্যবহার করে মাংস কাটা হয় সেটি না ধুয়েই যদি আবারো রান্না করা হবে না এমন খাবার যেমন ফল বা সালাদ কাটা হয় তাহলে সেটি দূষিত হয়ে পড়ে। কারণ মাংসে থাকা ব্যাকটেরিয়া তখন ঐ ফল বা সালাদেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
  • ফ্রিজে যদি রান্না করা খাবারের সাথে কাঁচা মাংস সংরক্ষণ করা হয় তাহলেও সেটি দূষিত হওয়ার শঙ্কায় থাকে।

    কসাইখানার পরিবেশ যেমন হওয়া উচিতঃ
  • মাংস বিক্রির উদেশ্যে জবাই করা প্রাণীকে আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রোগমুক্ত প্রমাণ হলেই জবাই করা যাবে।
  • অভিজ্ঞ কসাই দ্বারা ব্যাথামুক্ত হালাল উপায়ে জবাই করতে হবে।
  • জবাইয়ের স্থান একটু উঁচু জায়গাতে এবং উপরে ছাউনি দিতে হয়।
  • মাংস প্রস্তুতের সাথে জড়িতদের জন্য আলাদা জুতা, হ্যান্ডগ্লাভসের ব্যবহার করতে হবে।
  • অন্যকোন প্রাণী বা কুকুর যেন না আসতে পারে সেজন্য কসাইখানাতে বাউন্ডারি বা ঘেরাও দিতে হবে।
  • জবাইয়ের পর সহজে যেন রক্ত ও ময়লা ধোঁয়া যায় এজন্য উপযুক্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখতে হবে। জবাইয়ের স্থান সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
  • মাছি যেন না আসে এজন্য মাংস বিক্রির স্থান সর্বদা পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। জায়গা পরিষ্কার রাখলে মাছির অত্যাচার কমে যাবে।
  • মাংস সর্বদা ঢেকে রাখতে হবে।
  • কন্টামিনেশন রোধে বিক্রেতার ছুরি, চাপাতি পরিষ্কার রাখতে হবে।

 

লেখকঃ আর এস মাহমুদ হাসান
শিক্ষার্থী, এনিম্যাল সায়েন্স এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

?>