দেশের বাজারে গরুর মাংসের দাম কেন বেশি?

সাধারণত যখন চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম থাকে তখন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। তাহলে কি বাংলাদেশে চাহিদা তুলনায় গরুর মাংসের উৎপাদন হচ্ছে না? গত ১৫ অক্টোবর, ২০২৩ এ প্রকাশিত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন হয়েছে ৮৭.১০ লাখ মেট্রিক টন। মাথাপিছু প্রতিদিন ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদার বিপরীতে প্রাপ্যতা ১৩৭.৩৮ গ্রাম। যদিও সেটা আবার ২০২১-২২ অর্থবছরের থেকে কম। সে বছর মাংসের উৎপাদন ছিল ৯২.৬৫ লাখ মেট্রিক টন ও দিনে মাথাপিছু মাংসের প্রাপ্যতা ছিল ১৪৭.৮৪ গ্রাম। ২১-২২ বছরের চেয়ে ২২-২৩ এ উৎপাদন কিছুটা কম হলেও প্রাপ্যতার হিসেবে বরং

চাহিদার তুলনায় বেশিই উৎপাদন হয়েছে। মাংসের উৎপাদন কমলেও কিন্তু ২২-২৩ অর্থবছরে গবাদি পশুর সংখ্যা বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে গবাদিপশু ও পোল্ট্রির সংখ্যা যেখানে ছিল ৪৩ কোটি ২৩ লাখ ৭৯ হাজার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৪৪ কোটি ২৮ লাখ ৪৭ হাজার।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে ঈদুল আজহা ২০২৪ এ কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা বেড়েছে। ছাগল ভেড়া দুম্বাসহ অন্যান্য পশুর সংখ্যা কমলেও বেড়েছে গরু- মহিষের সংখ্যা। গতবারের তুলনায় এবার গরু ও মহিষের সংখ্যা বেশি ৫ লাখ ১৬ হাজার। অর্থাৎ এবার গরু-মহিষের সংখ্যা বেড়েছে ১০.৬৭ শতাংশ, যা ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এখন প্রাণিসম্পদের সংখ্যা বাড়লে তো মাংসের উৎপাদন কমার কথা নয়! মাংসের দাম কমারও কথা ছিল, তাহলে কি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বিভ্রান্তিকর? যাই হোক দামের কারণে সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনতার খাবারের প্লেটে আর উঠছে না মাংস।

এইতো গত রমজানে বাজারে তরমুজের দাম বেশি রাখায় তরমুজ বয়কটের জোয়ার উঠলে ব্যবসায়ীরা তরমুজের দাম কমাতে বাধ্য হয়। ভোক্তারা এখানে সফল কারণ তরমুজ পঁচনশীল। এখন বাজারে গরুর মাংসের অতিরিক্ত দামের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে গরুর মাংস বয়কটের ঘোষণা দিচ্ছেন। এতে কি দাম কমবে গরুর মাংসের? হয়তো না, বা সময় বলে দিবে! কারণ গরু পঁচনশীল নয়, এয়াড়া একজন প্রান্তিক খামারি সরাসরি গরু জবাই দেন না। গরুর বেপারী/দালাল খামারিদের থেকে গরু কিনে আবার মাংস ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করছেন। এই হাত বদলে ভোক্তা ও খামারি দুইদলই পড়েছেন বিপদে, মাঝ থেকে মুনাফা লুটছেন মধ্যসত্বভোগীরা।

১৫ মার্চ, ২০২৪ তারিখে সরকার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয়। যেখানে বলা হয় গরুর মাংসের উৎপাদন খরচ ৫৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। উৎপাদক পর্যায়ে গরুর মাংসের কেজি ৬০৫ টাকা ১৩ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ৬৩১ টাকা ৬৯ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ৬৬৪ টাকা ৩৯ পয়সা বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে মাংস ব্যবসায়ীরা কি এই নির্দেশনা মেনেছেন? ভোক্তাদের তো ঠিকই গরুর মাংস বিভিন্ন  সময় বিভিন্ন দামে কিনতে হচ্ছে। যেমন রমজানের আগে দাম কমে প্রতি কেজি মাংস ৬০০-৬৫০ টাকা, রমজান মাসে দাম বৃদ্ধিতে ৭০০-৭৫০ টাকা, এখন ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে ভোক্তাদের গরুর মাংস আরো বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর ২১ মে, ২০২৪ এর বাজার দরে গরুর মাংসের বর্তমান দাম দেখা যাচ্ছে ৭৫০-৭৮০ টাকা।

সম্প্রতি ফুটবলের দেশ ব্রাজিল ৫ ডলারের ভিতরে বা ৪৯৫ টাকা কেজিতে আমাদের গরু মাংস দিতে চেয়েছে। এই মাংস আমদানি করা আমাদের জন্য ঠিক হবে কিনা? এদিকে দৃষ্টি দিলে কয়েক বছর আগে আমাদের ফিরে যেতে হবে, যখন আমরা ভারতীয় গরুর উপর নির্ভরশীল ছিলাম। এক পর্যায়ে ভারত গরু রপ্তানি বন্ধ করার পর বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। এমন কি কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। বিগত কয়েক বছর ধরে কোরবানির জন্য গবাদি পশু আমদানির কোন প্রয়োজন পড়ে নি, দেশীয় উৎস থেকে কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিভিন্ন উদ্যোগে খামারিরা আগের তুলনায় গবাদি পশু হৃষ্টপুষ্টকরণ, খামারের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে বেশ উৎসাহিত হয়েছে, যার দৃশ্যমান প্রতিফলন হয়েছে ২০২৩ সালের ঈদুল আজহার গবাদি পশুর হাটগুলোতে। যার ফলে লাভবান হচ্ছে দেশীয় খামারিরা। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ঈদুল আজহা ২০২৩ উদযাপনে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দেশে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু প্রস্তুতছিল ১.২৫ কোটি এবং কোরবানি হয়েছিল ১.০০৪ কোটি। ২০২৩ সালে কোরবানির পশুর বাজারে ৬০৩৬৬.৯৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, যার সিংহভাগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে সংযুক্ত হয়েছে। গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন, ব্রাহমা জাতের মাংস উৎপাদনক্ষম গরুর সংযোজনও সম্প্রসারণ এবং ব্যাপকহারে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণের মাধ্যমে দেশের চাহিদা শতভাগ পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করার সুদূর প্রসারী কর্মপরিকল্পনা গস্খহণ করেছে বলে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় মারফতে জানা যায়।

আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা ২০২৪ এ কোরবানির পশুর কোনও সংকট হবে না বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী আব্দুর রহমান। গত ১৬ মে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় মন্ত্রী জানিয়েছেন, “সারা দেশে এবার কোরবানিযোগ্য ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি পশু প্রস্তুত আছে, যা গতবারের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি বেশি। কোরবানির চাহিদার চেয়ে ২২ লাখ ৭৭ হাজার ৯৭৩টি অতিরিক্ত গবাদিপশু প্রস্তুত রয়েছে"। এর সবই দেশীয় খামারিদের উৎপাদিত। এখন আমদানির সিদ্ধান্ত নিলে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার শামিল হবে, আমাদের দেশীয় শিল্প ধ্বংস হবে। এয়াড়া আমদানি করা মাংসের গুণগত মান, পশু হালাল পদ্ধতিতে জবাই করা হয়েছে কিনা তা নিয়েও জনমনে সংশয় জাগবে।

একটা গরুকে মাংসের উপযোগী করে তুলতে খামারিকে তার পিছে ২-৩ বছর খাটতে হয়। পরিচর্যা খরচের খাতগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে ফিড, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, পরিবহন প্রভৃতি খাতের দিকে নজর দিতে হবে। বিগত বছরগুলোতে খরচ বেড়েছে প্রতিটি খাতে। খামারির সবচেয়ে বড় খরচটা যায় ফিডে, ফিড ক্রয় বাবদ ব্যয় হয় ৭০-৭৫%। কিন্তু বিগত ২-৩ বছরে ফিডের মূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা অবস্থায় আছে খামারিরা। বৈশ্বিক উৎপাদন ও সরবরাহে ঘাটতি থাকায় কয়েক বছর ধরে অস্থিতিশীল ফিডের আন্তর্জাতিক বাজার। আন্তর্জাতিক বাজারে ফিডের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে দেশের লাইভস্টক সেক্টরে। যার কারণে দাম বেড়েছে পশুখাদ্য তৈরির প্রধান উপাদান সয়াবিন, গম ও ভুট্টার। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে, ব্যাংক খুলছেনা এলসি। মূল্য বৃদ্ধির জন্য আমদানি হয়েছে চাহিদার চেয়েও কম। ফিডের কাঁচামালের দাম বাড়ায় অনেক ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফিড উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। এজন্য আগের চেয়েদ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে পোল্ট্রি, মৎস্য ও ক্যাটল ফিড। পণ্য উৎপাদনের ব্যয়ের সাথে আয়ের ভারসাম্য না হওয়ায় লোকসানে পড়েছেন খামারিরা। এতে করে বাজারে ফিড সংকটের পাশাপাশি দাম বেশি হওয়ায় খামার বন্ধ করে পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

দেশে এখন অনেকটা কৌতুকের মতো বলা হয় এই পণ্যের দাম বেড়েছে, দায় কার? ইউক্রেন যুদ্ধের! এখন আসুন ফিডের মূল্য বৃদ্ধিতে ইউক্রেন যুদ্ধের দায় কতটা দেখা যাক। ইউরোপের রুটির ঝুড়ি বলা হয় ইউক্রেনকে। দেশটির মোট ভূখÐের ৭১ শতাংশই কৃষি জমি। বিশ্বের প্রধান দুই খাদ্য উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই দেশই দানাদার খাদ্যে সারাবিশ্বে সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গা। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট গম রপ্তানির ২৯ শতাংশ, ভুট্টা রপ্তানির ১৯ শতাংশ, সূর্যমুখী তেল রপ্তানির ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে এই দুই দেশ। যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ইউক্রেনের রপ্তানি এখন বন্ধ হওয়ার মুখে। অন্যদিকে রাশিয়া আছে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে। এজন্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খাদ্য শস্যের দাম।

পোলট্রি ও ডেইরি ফিড তৈরির বেশির ভাগ উপাদান বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। ফিড ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি) এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ফিড ইন্ড্রাসিতে বছরে প্রায় ২০ লাখ টনের মতো সয়াবিন মিল লাগে। দেশে চাষ হয় মাত্র দেড় লাখ টনের মতো। চাহিদার বাকিটুকু আমদানি করতে হয়। তেল পরিশোধন প্রতিষ্ঠানগুলি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সরাসরি সয়াবিন সিড আমদানি করে। এই সয়াবিন সিড থেকে তেল বের করে বাকি যা পাওয়া যায় তার পুরোটায় ডেইরি, পোল্ট্রি ও মৎস্য ফিড মিলে যায়। সেখান থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণের পর ফিড তৈরি হয়। কারখানায় ১০০ কেজি সয়াবিন সিড মাড়াই করলে তার থেকে ২০% সয়াবিন তেল ও ৮০% সয়াকেক/খৈল উৎপাদিত হয়। ফিডে ভুট্টা ও সয়াকেক ব্যবহার হয় ৮০ শতাংশ, (যার ভিতরে ভুট্টা ৫০-৫৫ ও সয়াকেক ২০-২৫ ভাগ পরিমাণে থাকে) এবং বাকি ২০ শতাংশ অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করা হয়।

গো-খাদ্যের ক্রমবর্ধমান দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে সাধারণ খামারি ও ভোক্তা দুই শ্রেণি। গো-খাদ্যের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে দুধ উৎপাদন ও পশু মোটাতাজাকরণে ব্যয় বেড়েছে খামারিদের। এতে করে গবাদি পশুপালনে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এ অবস্থায় দানাদার খাদ্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ঘাস চাষ বাড়িয়ে খাদ্যের খরচ কিছুটা কমানো যায়। এয়াড়া নিয়মিত ভ্যাক্সিনেশনের ব্যবস্থা করা গেলে রোগ-বালাই থেকে পশুকে মুক্ত রাখা যাবে, ফলে, চিকিৎসা খরচও কমে আসবে।

লাইভস্টক তথা পোল্ট্রি, ডেইরিখাতকে ঘিরে সিন্ডিকেটের তৎপরতা ও ফিডের মূল্য বৃদ্ধিতেও দায়ী। যেসব প্রতিষ্ঠান এ খাতে লিড দেয় তারাই মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। নিয়ন্ত্রণশারী প্রতিষ্ঠানগুলি একটি দাম দিয়ে দেয় পরে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলি তার আশে পাশে দাম নির্ধারণ করে। এই যে ফিডের দাম বাড়ার চাপ সামলাতে না পেরে খামার বন্ধ করছেন অনেক উদ্যোক্তা, কাঁচামাল সংকটে বন্ধ হচ্ছে ফিডমিলও। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে বিশেষ বোর্ড গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, টেকসইভাবে ঘুরে দাঁড়াতে এ খাতের জন্য যেমন দরকারএকটি শক্তিশালী নীতিমালা, তেমনি দরকার সমন্বিতএকটি বোর্ডও। একই সঙ্গে দেশে ভুট্টা ও সয়াবিনের চাষ বাড়ানোর পরামর্শ খাত সংশ্লিষ্টদের। সয়াবিন মিলের দাম যেন অতি মাত্রায় বেড়ে না যায় বা সংকট বেড়ে না যায় এজন্য সরকারকে পর্যাপ্ত মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণের কথা বিবেচনায় এই খাতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দিতে পারে সরকার। একই সঙ্গে দেশে গম, ভুট্টা ও সয়াবিনের চাষ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

 

লেখকঃ আর এস মাহমুদ হাসান

তরুণ কলামিস্ট ও এম এস শিক্ষার্থী, মেডিসিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

?>