আমেরিকার সর্বদক্ষিণ পয়েন্ট কি ওয়েস্টে (Key west)- একদিন

ডা মো মুস্তাফিজুর রহমান পাপ্পু: সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে মোটামুটি সপ্তাহ দুয়েক এর ছুটি পাওয়া যায়। আর ফল সেমিস্টারের পরে সেটা আরো কিছুদিন হয়ে যায়। এবারের ছুটিতে কোথাও না কোথাও যাওয়ার প্লান করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করি। যেহেতু আমি মায়ামি থাকি, তাই এর আশে পাশে দর্শনীয় কিছু স্পট নিয়ে আলাপ হল। অভি ভাই হটাত করেই আমেরিকার সর্বদক্ষিনের  স্থান ভ্রমণের প্রস্তাব দিল। সাথে সাথেই গুগল মামার কাছে চলে গেলাম। মামাও ইংগিত দিল,

হ্যাঁ আমার এই দিকেই যাওয়া উচিত। ব্যাস বাধন দা আর আবু বকর ভাই ও রাজি হল। আমাদের এই ভ্রমণে বাধন দা সকালের নাস্তা আর দুপুরে খিচুড়ি আর মুরগীর মাংশ ভুনা রান্না করার দায়িত্ব অর্পিত হল আমার উপর । যেহেতু ১৬ ই ডিসেম্বর  আমাদের মহান জাতীয় দিবস তাই এই ট্যুরের নাম দিলাম বিজয় দিবস ট্যুর।

সব আয়োজন শেষে আমরা ২০ তারিখ বুধবার সকালে মায়ামী থেকে রওয়ানা দিলাম। অভি ভাই আমাকে ও বাধন দা কে পিক করে হোমস্টেডে আবু বকর ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমাদের প্লান ছিল অভি ভাই মায়ামি টু হোমস্টেড পর্যন্ত আর আবু বকর ভাই হোমস্টেড টু কী ওয়েস্ট পর্যন্ত ড্রাইভ করবেন। গাড়িতে ঊঠেই ফুল স্পীডে অভি ভাই গান বাজালেন। এটা নাকি তার ফুয়েল। লং জার্নিতে গান কার না ভালো লাগে। ৩৫ মিনিটের মধ্যে আমরা আবু বকর ভাইয়ের বাসায় পৌছে গেলাম। ভাইকে নিয়ে শুরু হল আমাদের জার্নি।

কী ওয়েস্টে এবার আমাদের প্রথম ভ্রমণ । তবে অভি ভাই ব্যাতিক্রম। ইতিমধ্যে ২/৩ বার ভ্রমন করেছন, কিন্তু এবারের টা ব্যতিক্রম। হোমস্টেড থেকে আমাদের গন্তব্যস্থানের দুরত্ব প্রায় ১৩০ মাইলের মত। শহর পেরিয়ে ইউএস ১ রোড ধরে সোজা যেতে শুরু করলো আমাদের গাড়ি। বাধন দার দায়িত্ব লোকেশন অনুযায়ী আমাদেরকে গুগল মামার সাহায্য নিয়ে নিয়ে যাওয়া। কী ওয়েস্টের রাস্তায় সর্বোচ্চ ৫৫ মাইল  গতিবেগে গাড়ি চালাতে হবে। এখানে বেশী জোরে যাওয়ার কোন সুযোগ নাই। কী লারগো তে পৌছামাত্র অপরূপ সৌন্দর্য্য আপনাকে বিমোহিত করবে। দুই পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে কখন যে ঘড়ির কাটায় দুপুর হল টেরই পেলাম না। ইসলারামোরাডা , লেইটন পার হয়ে ম্যারাথনে এসে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা হল। আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে সেভেন মাইল ব্রিজ। পাশাপাশি দুইটা সেতু। একটি পরিত্যাক্ত, তবে স্থাপনা রেখে দিয়েছে। পর্যটকদের পায়ে হাটার জন্য কয়েক মাইল উন্মুক্ত আছে এখনো। আমাদের গাড়ি যখন ব্রীজের পার হচ্ছিল, এক অন্য রকম ভাল লাগা কাজ করছিল। বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু পদ্মা বহুমুখী সেতু অতিক্রমই ছিল আমার সেরা মুহুর্ত। কিন্তু আজ সেই ব্রীজের প্রায় দ্বিগুন সেতু অতিক্রম করলাম। এই সেভেন মাইল ব্রিজ নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৮-৮২ সালের দিকে। প্রথমে ফ্লোরিডার সাথে এই অঞ্চলের রেল যোগাযোগের জন্য একটি ব্রিজ ছিল যা ১৯৩৫ সালের হারিকেনে বিধ্বস্ত হয়। ১৯৬০ সালে হারিকেন ডানা’র আঘাতে আবারো ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্রীজটি।  আমাদের যাত্রার অন্যতম আকর্ষণ ছিল এটি। ও হ্যাঁ কোন টোল দিতে হয় নাই কিন্তু। ব্রীজ পার হয়েই আটলান্টিকের পাড়ে বসে ভুনা খিচুড়ি আর মুরগীর মাংশ দিয়ে জমিয়ে লাঞ্চ করলাম। দেরী না করে আবারো চলতে লাগলো আমাদের গাড়ি। প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমরা কী ওয়েস্টে ডাউন টাউনে পৌছাইলাম। আমাদের  হাতে সময় বেশী ছিল না। ৫ ডলার ঘন্টা প্রতি হিসেবে গাড়ি পার্কিং করে বের হলাম দর্শনীয় স্থান ভ্রমণে। আবহাওয়া ছিল চমৎকার। পর্যটকদের আনাগোনা বেশ ভালোই মনে হল। যোহর আর আছরের নামাজ আদায় করলাম জাহাজের জেটির কাছেই। এবার শহরটাকে এক্সপ্লোর করার পালা। স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা যে কয়টি স্পট ভ্রমণ করতে পেরেছিলাম তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলাম-

 

সাউদার্ন মোস্ট পয়েন্টঃ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ব দক্ষিণের স্থান হল কী ওয়েস্ট। এখানে একটি মনুমেন্ট ও আছে। এটাকেই সাউদার্ন পোস্ট পয়েন্ট অফ ইউএস এ বলে। এখান থেকে কিউবার হাভানা শহরের দুরুত্ব মাত্র ৩০ মাইল। তবে এই পয়েন্ট থেকে কিউবার দূরত্ব ৯০ মাইল। সকল পর্যটক এই মনুমেন্টের সাথে ছবি তুলেন। ছবি তোলার জন্য রীতিমত লম্বা এক লাইন দেখলাম। যদি লাইন অনুযায়ী ছবি তুলতে হয় তাহলে কমপক্ষে ১-১.৫ ঘন্টা লাগবে। তাই মনুমেন্টের সামনে এসে ঝটপট কয়েকটি ছবি তুলেই দিলাম দৌড়। পরের গন্তব্য লাইট হাউজ।

লাইট হাউজঃ

এটা ডাউনটাউনে অবস্থিত। বিশাল আকৃতির এটির উচ্চতা ৬৫ ফিট। ১৮২৫ সালে নির্মিত এই লাইটহাইজের চুড়া থেকে পুরা শহরের সৌন্দয্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। প্রাপ্তবয়স্ক এক জনকে গুনতে হবে ১৭ ডলার।

আর্নেস্ট হেমিঙ্গোয়ের বাড়ি ও যাদুঘরঃ

নোবেল জয়ী আমেরিকার বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট মিলার হেমিঙ্গোয়ের বসতবাড়ি যা এখন যাদুঘরে পরিনত হয়েছে। ১৯৩০ সালে নির্মিত এই বাড়িতেই তিনি লেখালেখি করতেন। গুনী এই সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ১৯৫৩ সালে পুলিতজার পদক ও ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরুস্কার অর্জন করেন। বর্তমানে এই বসতবাড়িতে পর্যটকরা লেখকের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র দর্শন করেন।

 

লিটল হোয়াইট হাউজঃ

১৮৯০ সালে নির্মিত হয় এই হাউজ মুলত ইউএস নেভী অফিসার দের জন্য। বিভিন্ন সময়ে আমেরিকান অনেক প্রেসিডেন্ট এই হাউজে অবকাশ যাপন করেছেন। ১ম বিশ্ব যুদ্ধের সময় নোবেল বিজয় টমাস আলভা এডিসিন এখানে অবস্থান করেছিলেন এবং যুদ্ধকালীন আন্ডার ওয়াটার বিভিন্ন অস্ত্রের পরীক্ষা করেছিলেন।। এছাড়া ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় এই ভবন কমান্ড হেড কোয়ার্টার হিসেবে ব্যাবহার করা হত। ৩৩ তম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান ১৭৫ দিন এই হাউজে অবস্থান করেন। এছড়া জন এফ কেনেডী, উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফট, ডিউইট এইসেনহাওয়ার, জিমি কার্টার ও বিল ক্লিনটনের মত ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট গন এই হাউজ ব্যবহার করেছেন। এত ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল স্থাপনা দেখার লোভ কে মিস করতে চায়। যদিও গোধুলি লগ্নে গিয়েছিলাম তাই ছবি তুলেই চলে আসতে হল।

ম্যালরি স্কয়ারে সুর্যাস্তঃ

কী ওয়েস্ট ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ হল ম্যালরি স্কয়ারে সুর্যাস্ত। এটা ডাউনটাউনের অদূরে অবস্থিত। সুর্যাস্তের ঘন্টা খানেক আগে থেকেই পর্যটকরা এই স্থানে আসতে শুরু করে। বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট দোকানিরা তাদের পন্য নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন। বাংলাদেশে কক্সবাজার বা সেন্টমার্টিন কিংবা কুয়াকাটায় গেলে যেমন শামুকে নাম লেখানো একটা খুবই পরিচিত বিষয়। ঠিক এখনেও এই ধরনের দোকান পাইলাম। দাম চাইল ১০ আর ১৫ ডলার প্রতি পিস।  কিছু গনক বা তান্ত্রিক দেখলাম মানুষের ভবিষ্যত বলে দেওয়ার কথা বলে দেদারছে ব্যবসা করছে। কেউ কেউ আবার শারীরিক করসত দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। পপ কর্ন , বিভিন্ন আইটেমের স্ট্রিট খাবারের দোকান ও ছিল চোখে পড়ার মত। এই স্থানটিকে আমার খুবই পছন্দ হইছে। মনে হচ্ছিল এখানেই বসে থাকি। কিন্তু আবু বকর ভাই বীচে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছিলেন, আমরা দুই জনই সমুদ্রস্নান করার জন্য কাপড় এনেছিলাম। অভি ভাই অবশ্য ম্যালরি স্কয়ারেই সুর্যাস্ত দেখে যাইতে চাইছিলেন। অবশ্য দুই পক্ষের দোলাচলে আবু বকর ভাই আর বাধন দা ই জয়ী। আমরা সেই সী বিচে যেতে যেতে সুর্যাস্ত হয়েই গেছিল।

ফোর্ট যাচারি টেইলর স্টেট পার্কঃ

গোধুলি লগ্নে আমরা ম্যালরি স্কয়ার থেকে দিলাম দৌড়। যেহেতু সি বীচে গিয়ে সুর্যাস্ত দেখব তাই রীতিমত দম ফেলার সময় ছিল না। মোটামুটি ২০ মিনিট হাটার পর আমরা পৌছালাম। সুর্য দেখতে দেখতে আমরা আগাচ্ছিলাম। কাছাকাছি আসতেই চলে পড়লো ইউএস কোস্ট গার্ডের অফিস আর পাশেই ছিল একটা গেইট। কিন্তু আমরা অবাক হচ্ছিলাম বীচে ঢুকতে গেইট কিসের? এখানে ঢুকতে আবার জন প্রতি ২ দশমিক ৫০ ডলার দিতে হবে। যাই হোক শেষ মুহুর্তে হওয়ার গেট্ম্যান আমাদের ফী ছাড়াই ঢুকতে দিলেন। এই পার্ক টা কিছুটা বাংলাদেশের ভাওয়াল বনের মত। বনের মধ্য দিয়ে গিয়ে সমুদ্র সৈকতে যেতে হয়। এখান পৌছে আমাদের আক্ষেপ আরো বেড়ে গেল। কেন আগে আসলাম না এই নিয়ে তর্কাতর্কি হল। আসলেই অসম্ভব সুন্দর এই বীচ। সুর্য অস্ত হয়ে গেছে কিন্তু রক্তিম আভা পেয়েছিলাম। মাগরিবের নামাজ পড়ে কিছু ছবি তুলতেই গার্ড এসে বের হতে অনুরোধ করলেন। অর্থ্যাৎ সকাল ৮ টা থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত খোলা থেকে এই বীচ।

অবশেষে ক্লান্ত শরীরে ক্ষুধা পেটে চলে গেলাম অভি ভাইয়ের পরামর্শে সাব ওয়ে তে। এশার নামাজ পড়ে আল্লাহর উপর ভরসা নিয়ে বিদায় দিলাম কী ওয়েস্ট কে। সাথে রইল অল্প সময়ে মধুর কিছু স্মৃতি যা আবারো আমাকে এখানে টেনে নিয়ে আসবে ইনশাল্লাহ।

ট্যুরের ভিডিও - https://www.facebook.com/DrPappuTheTraveller/videos/2002315843487082

 

লেখকঃ ডা মো মুস্তাফিজুর রহমান পাপ্পুঃ 

সাধারন সম্পাদক: আটলান্টিস বিশ্ববিদ্যালয় স্টুডেন্ট লাইফ অর্গানাইজেশন - মায়ামি, ফ্লোরিডা

৭১৬ ৪১৬ ৮৮৪৭

?>