হালাল মাংস এবং এ সংক্রান্ত মৌলিক বিষয়াদি

অনেকদিন ধরেই একটা ইচ্ছা ছিল “হালাল” মাংস নিয়ে একটু জানা এবং এ ব্যাপারে মৌলিক বিষয়ে একটা লেখা প্রকাশ করা। সেই নিমিত্তে একটু পড়ালেখা করার পর আজ এই লিখাটা লিখলাম। আমি যেহেতু মাংসের গুনাগুন উন্নয়নের উপায় নিয়ে গবেষণার কাজ করি, এবং বর্তমানে বিভিন্ন উন্নত দেশে হালাল মাংসের বাজার দিনে দিনে বিকশিত হচ্ছে, তাই এই সম্পর্কে লিখার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

মাতৃভূমি বাংলাদেশে থাকতে মুসলিম বন্ধু মহলের তেমন কাউকে “হালাল” খাবার বিশেষত “হালাল” মাংস নিয়ে খুব একটা কথা বলতে শুনি নাই বা চিন্তিত হতে দেখি নাই। সেটা হয়ত বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ হওয়াতে সবাই ধরেই নেয় যে, বাংলাদেশ এ সকল গবাদিপশু হালাল উপায়েই জবাই করা হয়। ক্যানাডাতে আসার পর অনেক মুসলিম বন্ধুকে

বলতে শুনেছি যে, কোথায় “হালাল” মাংস পাওয়া যায়, পাওয়া গেলে কিভাবে জবাই করা হয়েছে, আসলেই হালাল কি না?

পশু জবাই নিঃসন্দেহে পশুর মাংসপেশী (SKELETAL MUSCLE) মানুষের খাওয়ার উপযোগী মাংসে (MEAT) রূপান্তরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রধান এবং প্রথম প্রক্রিয়া। বর্তমানে আধুনিক জবাইখানায় এই মূল প্রক্রিয়াটি সম্পাদনের ক্ষেত্রে পশুর কল্যাণ (ANIMAL WELFARE), মানুষের খাদ্য হিসেবে মাংস ব্যবহারের নিমিত্তে খাদ্য নিরাপত্তা (FOOD SAFETY), খাদ্যের স্বাস্থ্যবিধি (HYGIENE), খাদ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা (SANITATION) ও সেইসাথে জবাইখানায় কর্মরত কর্মীদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ (SAFE WORKING ENVIRONMENT)  রক্ষার্থে এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নিয়ম কানুন কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মাংসের জন্য পশু জবাই এর প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। কারণ এটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করা না গেলে পশুতে সম্ভাব্য পীড়নের  (STRESS) ফলে মাংসের গুনাগুন এর উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে পশু কতৃক কর্মরত কর্মীদের আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই জন্য আধুনিক বাণিজ্যিক জবাইখানায় পশু জবাইয়ের আগে বিশেষ উপায়ে পশুকে  অজ্ঞান বা অচেতন (STUNNING) করা হয়, যাতে ভয় ও উদ্বেগ ছাড়া কম ব্যথা বা কম কষ্ট বা কম যন্ত্রণা দিয়ে পশুটিকে জবাই করা হয় এবং জবাইয়ের পর রক্তপাতের মাধ্যমে পশুটির মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। পশ্চিমা বিশ্বে প্রথমদিকে যখন পশু জবাইয়ের আগে পশুকে অচেতন  (STUNNING) করার পদ্ধতিটি চালু করা হয়েছিল, তখন মূলত জবাইখানায় কর্মরত কর্মীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই শুরু করা হয়েছিল। পশুকে জবাইয়ের পুর্বে অচেতন করা শুধুমাত্র পশুদের ব্যাথা মুক্ত জবাইয়ের জন্য করা হয় নি । এ থেকে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, জবাইয়ের পূর্বে পশুটিকে  অচেতন করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বড় বড় পশুগুলি (বিশেষ করে গরু, ঘোড়া, বাইসন ইত্যাদি) সহজে আয়ত্বে এনে জবাই প্রক্রিয়া সহজতর করা এবং জবাইখানায় কর্মরত কর্মীদের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। প্রথমিক অবস্থায় উদ্দেশ্য যাই থাক, সময়ের সাথে সাথে জবাইয়ের আগে পশুকে অচেতন (STUNNING) করার পদ্ধতিটি ধীরে ধীরে ব্যাপকতা পেয়েছে। বর্তমানে এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, জবাই করার আগে পশুকে অজ্ঞান করা উচিত, তাতে যেমন পশু কম ব্যথা পাবে বা কম ভুগবে তেমনি অন্যদিকে জবাই খানায় কর্মরত কর্মীদের পশু দ্বারা আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে যাবে। যদিও অনেক অনুন্নত দেশে অজ্ঞান করা ছাড়াই ধর্মীয় পদ্ধতিতে গবাদি পশু জবাই করা একটি সাধারণ রীতি হিসেবে এখনও প্রচলিত আছে এবং দেখা যায় যে, জবাইয়ের সময় অনেকেই পশু দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং অনেকে মারা যাওয়ারও রেকর্ড আছে । ঢাকা ট্রিবিউন এর ২০২১ সালের ২১ শে জুলাই এর অনলাইন পোর্টালের সংবাদ অনুসারে ২০২১ সালে ঈদ-উল-আযহার সময় কোরবানির পশু জবাই করতে গিয়ে এক ব্রাহ্মনবাড়ীয়া সদরেই ১০০ জন আহত হন এবং হাসপাতালে প্রাথামিক চিকিৎসা নেন। হাসপাতাল কতৃপক্ষের বর্ণনা  মতে, আহত সেই সব লোকজনের পশু জবাইয়ের অল্প স্বল্প বা একেবারেই কোন প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা ছিল না।

কোন কোন খাদ্য গ্রহণ করা যাবে এতদসংক্রান্ত ধর্মীয় নির্দেশাবলী শুধু ইসলামিক বিশ্বাসীদের জন্য অনন্য নয়। অন্যান্য অনেক ধর্মই ঐ ধর্মের বিশ্বাসীদের জন্য একটি খাদ্যতালিকা নির্ধারণ করেছেন যেমন-খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু এবং বৌদ্ধ সব ধর্মেই খাদ্যের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশনা আছে । এটি প্রাথমিকভাবে একটি জনস্বাস্থ্যের কাজ। যে সময়ে এই সব ধর্মীয় গ্রন্থগুলি লেখা হয়েছিল তখন খাদ্য সংরক্ষণ কৌশল এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার অনুশীলন ছিল আদিম বা প্রাচীন বা প্রারম্ভিক এবং অনেক ক্ষেত্রে  দূষিত বা পচে যাওয়ামাংসখাদ্য হিসেবে গ্রহণের ফলে মানুষ প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত (কখনও কখনও মানুষ ঐ সব মাংস খেয়ে মারাত্মক অসুস্থ হত এবং মারাও যেত)। পশু জবাই সংক্রান্ত ইসলামী আইন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য এবং দূষিত বা পচা গলা মাংস থেকে রোগের বিস্তার রোধ কল্পে এবং জবাইয়ের সময় গবাদি পশুর দুর্ভোগ (SUFFERING) সীমিত করা বা কমানোর জন্য প্রর্বতন করা হয়েছে।

ইসলামে হালাল খাদ্য বলতে কি বোঝায়?

“হালাল” একটি আরবি শব্দ যার অর্থ অনুমোদিত (ALLOWED, PERMISSIBLE), আইনসম্মত (LAWFUL), আইনি এবং বৈধ।  “হালাল” শব্দটি এবং এর প্রয়োগ ইসলাম ধর্মের মানুষের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বা কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । “হালাল” শুধুমাত্র খাদ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং আরও বিস্তৃতভাবে ইসলাম ধর্মাবলীদের জীবনের প্রতিটি দিককে বোঝায়: যেমন-সুদ হারাম, ব্যবসা হালাল, কীভাবে পোশাক পরতে হয়, অন্যদের সাথে কিভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয় বা চলতে হয়, অন্যদের সাথে ব্যবসায়িক বিষয়গুলি কিভাবে পরিচালনা করতে হয়। সেই অর্থে, “হালাল” মানুষের সামগ্রিক জীবনধারা সঠিকভাবে কিভাবে পরিচালিত হবে এবং মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মে আধ্যাত্মিকতা বজায় থাকবে তা বোঝায় ।

কিন্তু এই লেখাতে বিশেষ ভাবে খাদ্যের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলিই আলোচনা করা হবে। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে মাংস সম্পর্কিত বিষয়গুলি নিয়েই আজ আমি  বিশেষ ভাবে আলোচনা করব । “হালাল” খাবার ইসলামী মতানুসারে খাদ্যতালিকাগত নির্দেশিকা (DIETARY GUIDELINES) পূরণ করে এবং ইসলামী মতাদর্শের মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত। ইসলামিক নিয়ম মেনে সঠিকভাবে জবাই করা পশুর মাংস (যেমন- গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস, ছাগলের মাংস, হরিণের মাংস, বাইসন বা গয়ালের মাংস, মুরগি, টার্কি, মাছ এবং শেলফিশ ইত্যাদি) হালাল মাংস হিসেবে গণ্য হতে পারে।

খাদ্যের ক্ষেত্রে, হালাল হল খাদ্যের মান সম্পর্কিত একটি বিষয় যা পবিত্র কুরআনে নির্দেশিত। হালালের বিপরীত শব্দ হল হারাম, যার অর্থ অবৈধ বা নিষিদ্ধ। “হালাল” এবং “হারাম” শব্দ দুটি  মুসলিম জনগোষ্টীর জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই শব্দ দুটি সাধারণত খাদ্য জাতীয় পণ্য প্রধাণত মাংস, প্রসাধন সামগ্রী, কসমেটিক এবং ফার্মাসিউটিক্যালস উপকরণ এর মান সম্পর্কিত বিষয়ের ক্ষেত্রে অধিক ব্যবহৃত হয়। যদিও খাদ্য ছাড়াও অনেক কিছু আছে যা স্পষ্টভাবে হালাল বা হারাম হিসেবে শ্রেনী বিভাজন করে ইসলামে নির্দেশিত করা হয়েছে, কিন্তু কিছু জিনিস হালাল নাকি হারাম তা পরিষ্কারভাবে বলা নাই। এইসব জিনিস কে হালাল বা হারাম হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করার জন্য আরও কিছু তথ্যের প্রয়োজন। এই জাতীয়  জিনিস গুলিকে ইসলামে প্রায়শই “সুবাহ অথবা মাশবুহ (SYUBHAH or MASHBOOH)” হিসাবে উল্লেখ করা হয়, যার অর্থ সন্দেহজনক বা প্রশ্ন সাপেক্ষ। “হালাল খাবার” বলতে যে কোন খাবার যা ইসলামি “শরিয়া” আইন অনুযায়ী খাওয়ার জন্য অনুমোদিত বা বৈধ অনুমতি আছে। আপনারা হয়ত জানেন যে, শরিয়া এর অর্থ হল ‘পথ’ বা ‘উপায়’। ইসলামি শরিয়া আইন বলতে নীতি ও নিয়মের পুর্ণ ব্যবস্থা বোঝায়, যা একজন মুসলমানকে সত্যিকার ভাবে মেনে চলতে হয়। এটি ফৌজদারি এবং দেওয়ানী উভয় নিয়মের সাথেও সম্পর্কিত এবং এটি ব্যক্তিগত এবং নৈতিক আচরণকেও নিয়ন্ত্রনের নির্দেশনা প্রদান করে।

ইসলামে যে সকল খাদ্য খাওয়া নিষিদ্ধ বা হারামঃ

  • যে কোন মৃত পশুর মাংস
  • প্রাণীর রক্ত বা রক্ত থেকে তৈরি বা উৎপাদিত খাদ্য পণ্য।
  • শূকরের মাংস বা তা থেকে তৈরি বা উৎপাদিত খাদ্য পণ্য।
  • যে সকল প্রাণী জবাইয়ের সময় আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন নাম ডেকে বা স্মরণ করে জবাই করা হয়েছে বা আল্লাহর নাম উচ্চারণ ছাড়াই জবেহ করা হয়েছে। মানুষকে পশু জবাই ও ইহার মাংস খাওয়ার অনুমতির মূল শর্ত পশু জবাই এর সময় সৃস্টিকর্তার (ALLAH) নাম উল্লেখ করে পশু জবাই করা।
  • যে সকল পশু শ্বাসরোধ করে বা হিংসাত্মক আঘাতে বা মাথা উঁচু করে ধরে মেরে ফেলা হয়েছে বা যে সকল প্রাণী বন্য প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং তার মাংস আংশিকভাবে বন্য প্রাণী ভক্ষন করেছে । তবে যদি কেউ মৃত্যুর আগে পশুটিকে হালাল উপায়ে জবাই করে নিরাপদে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে, তার মাংস হালাল হতে পারে ।
  • লম্বা সূক্ষ্ম দাঁত (CANINE TEETH-যেমন বাঘ) বা লম্বা দাঁত (TUSK বা শুঁড়- যেমন হাতি) বিশিষ্ট প্রাণীর মাংস
  • সরীসৃপ
  • গাধা, খচ্চর (ঘোড়া নিষিদ্ধ নয়)। ইসলামের অধিকাংশ আলেমরা (SCHOLARS) ঘোড়ার মাংস খাওয়াকে বৈধ বলে মনে করেন।
  • অধিকাংশ পোকামাকড় (INSECTS) হারাম । পঙ্গপালকে (LOCUSTS, CRICKETS, GRASSHOPPERS) হালাল হিসাবে উল্লেখ করা ছাড়া ইসলামে পোকামাকড়ের (INSECTS) কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই ।
  • আঁইশ (SCALES) এবং পাখনা (FINS) ছাড়া মাছ। যে সব মাছের আঁইশ আছে তারা আবার পাখনা যুক্ত।
  • উভচর (AMPHIBIANS) প্রাণী হালাল নয় ।
  • কিছু বিশেষ প্রাণী আছে যেগুলোকে হত্যা করা এবং খাওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। এগুলি হল পিঁপড়া, মৌমাছি, শ্রাইক এবং হুপো।

ইসলামে খাদ্য হারাম হতে পারে যদি এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে: রক্ত, অ্যালকোহল, হারাম পশুর যে কোন মাংসজাত দ্রব্য, যার মধ্যে শূকর এবং কোনো মাংসাশী প্রাণী বা পাখির মাংস বা কোনো পশুর মাংস যা সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহর) নামে সঠিকভাবে জবাই করা হয়নি। ইসলামী আইনের (শরিয়া) অধীনে হারাম খাদ্য দ্রব্য খাওয়া তখনই বৈধ (হালাল) হবে যদি বেঁচে থাকার জন্য আর কোন খাদ্যদ্রব্য না থাকে তখন জীবন বাঁচানোর তাগিদে হারাম খাদ্য খাওয়া যেতে পারে । অন্যথায় হারাম খাদ্যদ্রব্য সব সময়ই হারাম বলেই বিবেচিত হবে । এ ব্যাপারে ইসলামে বলা হয়েছে জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে হালাল ও হারাম সম্পর্কে কিছু ব্যতিক্রম আছে।

জলজ উৎস তা সমুদ্র বা নদী বা পুকুর থেকে পাওয়া খাবার, যেমন মাছ এবং সামুদ্রিক খাবার নিয়ে মুসলমানদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মতাভেদ দেখা যায়। কিছু মুসলিম গোষ্ঠী শুধুমাত্র আঁইশ আছে এবং পাখনাযুক্ত মাছকে হালাল হিসাবে গ্রহণ করে আবার কিছু মুসলিম গোষ্ঠী সমস্ত জলজ প্রাণীকে হালাল হিসাবে বিবেচনা করে । এর মধ্যে ব্যতিক্রম হল- যে সব জলজ প্রাণী মানব স্বাস্থের জন্য বিষাক্ত, ক্ষতিকর বা নেশা জাতীয় পদার্থ ধারন করে। ফলস্বরূপ, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, কাঁকড়া এবং ক্লাম বেশিরভাগ মুসলমানদের জন্য হালাল কিন্তু কিছু মুসলিমের কাছে ঘৃণ্য (মাকরূহ) হতে পারে এবং তাই তাঁদের কাছে হালাল নয় বা খায় না। জলজ প্রাণী হল তারা যারা পানিতে থাকে এবং পানির বাইরে বেঁচে থাকতে পারে না। ইসলামিক প্রক্রিয়ায় জবাই না করেও জলজ প্রাণীকে হালাল বলে গন্য করা হয়। কাঁকড়া হালাল কি না তা অনেক মুসলমানের কাছে একটি আলোচনা বা জানার বিষয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম মনে করে যে, জলজ কাঁকড়া হালাল। এর অর্থ হল স্থলে বসবাসকারী কাঁকড়া হালাল নয়। স্থল কাঁকড়া থেকে জলজ কাঁকড়াকে কীভাবে আলাদা করবেন? জলজ কাঁকড়ার লেজে একজোড়া পিন থাকে যা স্থলে বসবাসকারী কাঁকড়ায় থাকে না।

প্রক্রিয়াজাত খাবারকে সঠিকভাবে হালাল বা হারাম হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা প্রায়ই কঠিন । কারণ এই সব খাবার সব সময় বিভিন্ন খাদ্য উপাদান এর মিশ্রণে বানানো হয়। অতএব, এটি হালাল প্রত্যয়িত কিনা তা দেখতে পণ্যটির লেবেল বা প্যাকেজিং পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোন সার্টিফিকেশন নির্দিষ্ট করা না থাকে, তাহলে ইহার উপাদানের তালিকা যাচাই করুন এবং হারাম বা নিষিদ্ধ উপাদান থাকলে বা সন্দেহ হলে হালাল নয় বলে ধরে নিতে পারেন। কোন খাদ্যদ্রব্য হালাল কি না এরকম সন্দেহজনক মনে হলে ওমুসলিমদের তা না খেয়ে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কিছু উদাহরণের মধ্যে রয়েছে: জেলাটিন, লাইপেস এনজাইম, পেপসিন এনজাইম, অ্যালকোহল, ভ্যানিলা নির্যাস (বিশুদ্ধ বা কৃত্রিম), পশুর চর্বি, পশুর রক্ত, পশুর রেনেট,  এবং প্রাণীর উৎস থেকে পাওয়া মনো- বা ডাই- গ্লিসারাইড এবং হোয়ে পাউডার ইত্যাদি। তবে ইদানিং আপনি হালাল জেলাটিন পাবেন যা মাছ বা হালাল প্রজাতির গবাদিপশুর চামড়া বা হাড় থেকে নিষ্কাশন করে বানানো হয়। আপনি বাড়ীতেই নিজেই  গবাদি পশুর চামড়া দিয়ে খুব সহজেই জেলাটিন বানাতে পারেন। প্রথমে গবাদি পশুর চামড়া ভাল্ভাবে ধুইয়ে সারা রাত ভিনেগার এ চুবিয়ে রেখে পরের দিন আবার পানি দিয়ে ধুইয়ে পানিতে ২-৩ ঘন্টা ফুটাবেন। তাতে চামড়ার মধ্যে থাকা কোলাজেন নামক পোটিন ভেঙে পানিতে দ্রবীভুত হয়ে যাবে। এর পর চিজ ক্লথ বা পাতলা কাপড় দিয়ে পানিটা ছেকে নিয়ে প্রথমে ঘরের তাপমাত্রায় রেখে ঠান্ডা করবেন। অতপর সারা রাত রেফ্রিজেরেটরে রাখলে দেখবেন যে পানিটা জেল (GEL) এ পরিণত হয়েছে। এটাকেই জেলাটিন বলা হয়। এই ভাবে আপনি নিজেই হালাল জেলাটিন বানাতে পারবেন।

“হালাল” মাংস বলতে যদিও বেশীরভাগ মুসলিমই প্রাথমিকভাবে বা প্রধানত পশুর জবাই প্রক্রিয়ার উপরই বেশী গুরুত্ব দেয় । কিন্তু জবাই প্রক্রিয়া ছাড়াও আরও অনেক বিষয় ‘হালাল” মাংস হিসেবে (বর্তমানে আধুনিক বাজারে প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার ক্ষেত্রেও) ব্যবহারের জন্য বিবেচনায় নিতে হয়। ইসলাম ধর্মে মানবিক উপায়ে পশু জবাইয়ের মাধ্যমে “হালাল” মাংস উৎপাদনের নিমিত্তে পশু জবাইয়ের নির্দেশিকা (GUIDELINES) প্রদান করা হয়েছে, যা অনুসরণ করা না হলেও মাংস হালাল বলে বিবেচিত হয় না:

  • মৌলিক এবং সাধারণ ধারণা হল যে, পশুর প্রতি মানবিক আচরণ ব্যতিরেকে আপনারা হালাল মাংস পেতে পারেন না। পশুর প্রতি এই মানবিক আচরণ পশুপালন পর্যায় থেকে শুরু করে জবাই করা পর্যন্ত হতে হবে।
  • কসাইখানায় জবাইয়ের জন্য ট্রাকে পশু পরিবহন এবং তাদের ট্রাক থেকে আনলোড আরামদায়ক (মানবিক আচরন করতে হবে ) অবস্থায় হওয়া উচিত ।
  • জবাই করার আগে পশুদের বিশ্রাম দেওয়া, ভালভাবে খাওয়ানো ( যদিও আধুনিক জবাই খানায় পশু জবাইয়ের আগে ১২-২৪ ঘন্টা খাবার দেয়া হয় না যাতে জবাইয়ের সময় পশুর পাকস্থলীতে খাবার না থাকে এবং জবাইয়ের পর পাকস্থলী ছিদ্র হয়ে পশুর CARCASS দুষিত না হয়। ) এবং ভালভাবে দেখাশোনা করা উচিত ।
  • জবাই করার আগে পশু অবশ্যই সুস্থ থাকতে হবে।
  • জবাই অবশ্যই একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম যিনি সুস্থ মনের অধিকারী এবং পশু জবাই করার জন্য ইসলামিক পদ্ধতি এবং শর্তগুলি সম্পূর্ণরূপে জানেন, বোঝেন এবং পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে অনুসরণ করবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন।
  • পশুটি জবাই করার সময় বা আগে আল্লাহর নাম নিতে হবে বা উচ্চারিত হতে হবে। অনেক মুসলমান বিশ্বাস করেন যে, হালাল মাংস যদি পাওয়া না যায়, তবে ইহুদি বা খ্রিস্ট ধর্মের (“AHL-AL-KITAB” অথবা PEOPLE OF THE BOOK) অনুসারীদের নির্দেশিত উপায়ে জবাই করা KOSHER মাংস গ্রহনযোগ্য হতে পারে।
  • পশু জবাইয়ের সময় জবাইকারীর মুখমন্ডল অবশ্যই মক্কার দিকে করে জবাই করতে হবে।
  • সন্তোষজনক ইসলামিক পদ্ধতিতে পশু জবাই (হালাল মাংস উৎপাদনের জন্য) করার জন্য অপারেটরের দক্ষতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নতুবা শর্তগুলি মেনে পশু জবাই করতে পারবে না।
  • পশু জবাইয়ের সরঞ্জাম এবং পশু থেকে প্রাপ্ত মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের অন্যান্য সরঞ্জামগুলি অবশ্যই শুধু মাত্র হালাল পশু জবাইয়ের জন্যই ব্যবহৃত হতে হবে।
  • পশু জবাই এ ব্যবহৃত ছুরিটি নির্দিষ্ট পশুর গলার প্রস্থের তুলনায় যথেষ্ট লম্বা (ছুরিটি পশুর গলার প্রস্থের চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ লম্বা হলে ভাল) হওয়া ভাল, অত্যন্ত ধারালো (ক্ষুরের ন্যায় ধার যুক্ত হবে যাতে ভারে নয়-ধারে কাটে ), পরিস্কার, দাগ (NICKS) ও ক্ষতি মুক্ত হতে হবে। তবে হালাল জবাইয়ের জন্য ব্যবহার করা ছুরির গঠন এবং আকার সম্পর্কে কোন ইসলামিক বিধান নেই।
  • জবাইয়ের সময় ছুরি দিয়ে পশুর গলার চারটি উপাদান যথা- দুইটি ক্যারোটিড ধমনী (CAROTID ARTERIES), দুইটি জগুলার শিরা (JUGULAR VEINS), শ্বাসনালী (TRACHEA) এবং খাদ্যনালী (OESOPHAGUS) অবশ্যই সম্পূর্ণ ভাবে কেটে বিচ্ছিন্ন করতে হবে । যার ফলে অবিলম্বে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়ে পশু দ্রুত মৃত্যু বরণ করবে এবং কম সময় ব্যাথায় ভুগবে (SUFFER)। তবে পশুটির মেরুদণ্ডের মেরুরজ্জু (SPINAL CORD) কাটা যাবে না এবং মাথাটি পশু মারা যাবার আগে দেহ থেকে  সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।
  • যে সব পশু জবাইয়ের জন্য বাছাই করা হয়েছে, সেই সব পশুদের উপস্থিতিতে পশু জবাইয়ের জন্য ব্যবহৃত ছুরি অবশ্যই ধার দেয়া যাবে না। জবাইয়ের পুর্বে পশুর সম্ভাব্য পীড়ন (STRESS) এড়ানোর জন্য ইহা করা উচিত নয়)।
  • পশু জবাই শুধুমাত্র ছুরির এক কোপে বা এক পোচ এ বা এক টানে (SINGLE SWIPE) সম্পন্ন করতে হবে (SAWING ACTION) । জবাই করার সময় ছুরির এক কোপ বা টানে পশু জবাই সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন করা না গেলে ছুরিটি না উঠিয়েই সামনে পিছনে পোচ দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব জবাই সম্পাদন করতে হবে। ছুরির এক পোচে পশু জবাই করা না গেলে যদি ছুরি উঠিয়ে আবার পোচ দেয়া হয়, তবে ধরে নেয়া হয় যে এক পশুকে দুই বার জবাই করা হয়েছে। একটি পশুকে একাধিক বার জবাই করা ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
  • পশুটিকে এমনভাবে জবাই করতে হবে যাতে দ্রুত তার মৃত্যু ঘটে এবং পশুটি কম সময় কষ্ট পায়।
  • রক্তপাত স্বতঃস্ফূর্ত এবং সম্পূর্ণ হতে হবে; রক্তপাত সম্পূর্ণ হওয়ার আগে পশুর দেহ বা পা শিকলে বেঁধে ঝুলানো উচিত নয়।
  • জবাইকৃত পশু মারা যাওয়ার সমস্ত লক্ষণ পর্যবেক্ষন করতে হবে এবং মারা যাওয়ার সকল লক্ষন নিশ্চিত হতে হবে এবং CEREBRAL REFLEX যেমন চোখের পলক না পড়লে, ধরে নিতে হবে যে পশুটির মৃত্যু হয়েছে । এর পর পশুর দেহ মাংসের জন্য কাটা বা ড্রেসিং এর জন্য প্রস্তত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে।

অনেকের মনে এই প্রশ্নটি জাগা স্বাভাবিক এবং জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে, গবাদিপশু এবং অন্যান্য প্রাণীদের যখন জবাই করার জন্যএ নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তারা কি জানে যে তারা এমন একটি পথে হাঁটছে যা তাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবে?" গবাদিপশুর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়ালেখা করা এবং এই শিল্পে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে এর উত্তর হল ব্যবস্থাপনা ভাল হলে তারা বুঝতে পারে না। গবাদি পশুর খামারে দৈনন্দিন কাজকর্ম যেমন টিকা প্রদান (VACCINATION) এর সময় গবাদিপশু গুলিকে সাধারণত CHUTE এ নেয়া হয় । জবাইখানা, ফিডলট (FEEDLOTS) এবং খামারগুলিতে গবাদিপশুর আচরণ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে, টিকা প্রদানের সময় এবং জবাইয়ের জন্য CHUTE এ প্রবেশ করার সময় গবাদিপশু প্রায় একই রকম আচরণ করে যদি ব্যবস্থাপনা খুব ভাল হয়। যদি গবাদিপশুরা জানতে পারত যে তাদের কে জবাই করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তবে জবাইখানায় নেওয়ার সময় তারা বন্য আচরণ করত এবং অনেক বেশী উত্তেজিত হতো, কিন্তু তা মোটেই দেখা যায় না। বৈজ্ঞানিক ভাবে ইহা পরীক্ষার জন্য গবাদিপশুর রক্তে পীড়নের হরমোন  (STRESS HORMONE) CORTISOL মেপে দেখা হয়েছে এবং এই দুই সময়ে CORTISOL এর পরিমাণের কোন ভিন্নতা পাওয়া যায় নি। যদি গবাদিপশু গুলিকে জবাইখানায় নেওয়ার সময় তারা জানত যে তাদেরকে জবাইয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাহলে জবাইয়ের পুর্বে বা জবাইয়ের সময় তাঁদের রক্তে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে CORTISOL (STRESS HORMONE) পাওয়া যেত। জেনে শুনে এই পৃথিবীতে কোন প্রাণী মরতে চায় ??

মাংস হালাল হওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত গুলোর মধ্যে একটি হলো জবাইয়ের সময় পশু অবশ্যই জীবিত থাকতে হবে। তাই কিছু মুসলিম জোর দাবী করেন এবং জোর দিয়ে বলেন যে, জবাই করার সময় পশু অবশ্যই জীবিত এবং সচেতন (CONSCIOUS) বা সজাগ থাকবে নতুবা সেই পশু থেকে প্রাপ্ত মাংস হালাল হবে না। কিন্তু মানবিক উপায়ে এবং পশুর কল্যাণ (ANIMAL WELFARE) এর নীতিমালা যথাযথ প্রয়োগ এবং জবাই খানায় কর্মরত কর্মচারীদের নিরাপত্তার জন্য আধুনিক জবাই খানায় পশু জবাইয়ের পুর্বে পশুকে অচেতন বা অজ্ঞান (STUNNING) করা হয় । সেই অচেতন পশুকে জবাইয়ের পর তা থেকে প্রাপ্ত মাংস হালাল হিসেবে গন্য করা হবে কিনা তা নিয়ে ইসলামী পন্ডিত বা আইনজ্ঞ বা আইনজীবীদের মধ্যে মত পার্থক্য আছে। অনেক ইসলামী আইনজ্ঞ মনে করেন পশুকে অচেতন করে জবাই করা হলেও সেই পশু থেকে প্রাপ্ত মাংস হালাল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু এর বিরোধীরা যুক্তি দেখান যে, এই প্রথাটি ইসলামী শরিয়া আইনের পরিপন্থী কারণ নবী পশুকে জবাইয়ের আগে অচেতন করার কথা বলেননি বা ব্যবহার করেননি । আবার অনেকে যুক্তি দেখান যে, পবিত্র কোরানের কোথাও বলা হয়নি যে, জবাইয়ের পুর্বে পশুকে অচেতন করলে সেই পশুর মাংস হালাল হিসেবে গ্রহন করা যাবে না। জবাইয়ের আগে অচেতন বা অজ্ঞান করলেও জবাইয়ের সময় যদি পশুটি জীবিত থাকে তবে এই পদ্ধতিতে জবাইকৃত পশুটির মাংস হালাল হিসেবে গ্রহন করা যেতে পারে বলে অনেক ইসলামী আইনজ্ঞ মনে করেন। তবে এখন পর্যন্ত অচেতন করার পর এবং জবাইয়ের পুর্বে পশুটি জীবিত থাকে, তা নিশ্চিত করার প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া এখনো নাই। অধিকন্তু, অনেকে মনে করেন যে, অচেতন প্রক্রিয়াটির ফলে জবাইকৃত পশুর শরীর থেকে পুরোপুরি ভাবে রক্ত নিষ্কাশন হতে পারে না । যদিও কয়েকটি গবেষণায় অচেতন করে  পশু জবাই গ্রুপ এবং অচেতন না করে পশু জবাই গ্রুপ দুটির মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এই দুই গ্রুপের মধ্যে পরিসংখ্যানগত ভাবে  রক্ত নিষ্কাশনের পরিমাণের উল্লেখ্যযোগ্য কোন পার্থক্য দেখা যায় নি।

জবাইয়ের পুর্বে পশুকে অচেতন বা অজ্ঞান (STUNNING) বলতে কি বোঝায়?

জবাই করার আগে পশুকে অচেতন বা অজ্ঞান করা হয় যাতে পশুটি জবাইয়ের সময় নড়াচড়া করতে না পারে এবং কর্মরত কর্মচারীদেরকে আঘাত করতে না পারে। এর ফলে পশুটি জবাইয়ের আগে বা জবাইয়ের সময় ভয় পাওয়ার বা উত্তেজিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। কারণ জবাইয়ের আগে পশুটি উত্তেজিত হলে পরবর্তীতে মাংসের গুণগত মানের উপর প্রভাব পড়ে বা উত্তেজিত হয়ে কর্মরত কর্মচারীদেরকে আক্রমন করতে পারে। বর্তমানে পশু জবাইয়ের পুর্বে পশুর প্রজাতি ভেদে একাধিক রকম ভাবে পশুকে অচেতন বা অজ্ঞান করা হয় ।

জবাইয়ের পুর্বে পশুকে অচেতন বা অজ্ঞান (STUNNING) করার ক্যাপটিভ বোল্ট পদ্ধতিঃ

এই পদ্ধতিটি সাধারণত গবাদিপশু, ভেড়া, ভেড়া এবং ছাগলের জন্য ব্যবহৃত হয়। একটি ক্যাপটিভ বোল্ট পিস্তল গবাদিপশুর খুলিতে গুলি করার জন্য ব্যবহৃত হয় যা তার কপালে প্রবেশ করে এবং এর BRAIN এর সেরিব্রামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে যাতে এটি সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে পড়ে। এটি যুক্তি দেওয়া হয় যে এই পদ্ধতিটি একটি পশু জবাই করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী মানবিক উপায়। কারণ এই প্রক্রিয়া সম্পাদনের পর গবাদি পশুকে জবাই করলে পশু জবাইয়ের সময় এবং জবাইয়ের পরে কম ব্যথা এবং যন্ত্রণা পায় বলে বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

যে কোন পদ্ধতিতেই পশু জবাই করা হোক না কেন তা পশুদের জন্য পীড়নযুক্ত। তাই এটা গুরুত্বপূর্ণ যে পশু অচেতন বা অজ্ঞান এবং জবাইয়ের সাথে জড়িত সমস্ত কর্মচারীরা অবশ্যই দক্ষ, সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত এবং পশুদের কল্যাণের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে এমন হওয়া উচিত । পশুর কল্যাণ, হালাল মাংস এবং বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠিত প্রমাণের উপর ভিত্তি করে পশু জবাইয়ের পর যাতে রক্তপাত সম্পূর্নভাবে সম্পন্ন করার জন্য এবং এই পুরো প্রক্রিয়াটি দক্ষ ভাবে পরিচালনার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন, যা ভোক্তাদের টেবিলে স্বাস্থ্যকর এবং তাঁদের পছন্দের মাংস যোগান দিতে পারবে । ত্রুটিমুক্ত পশু জবাই পদ্ধতিতে পশু জবাই করতে পারলে পশু কম ব্যথা পায় বা ভুগে এবং সেই উৎপাদিত মাংসের গুণগত মান বজায় রাখে।

মাংস হালাল হতে হলে এবং হালাল হিসেবে সার্টিফিকেশন পেতে হলে, খামার থেকে আপনার প্লেট (FARM TO FORK) পর্যন্ত পুরো সাপ্লাই চেইন হালাল হতে হবে। তাই হালাল পদ্ধতিতে গুণগত মান সম্পন্ন এবং খাদ্য  হিসেবে নিরাপদ মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রে পশুর জন্ম থেকে শুরু করে ভাল ভাবে পশু পালনের অনুশীলন, জবাই-পূর্ব ব্যবস্থাপনা, জবাই প্রক্রিয়া এবং জবাই পরবর্তী ব্যবস্থাপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে।

মুসলমানদের দ্বিতীয় বার্ষিক উৎসব ঈদুল আজহা’র দিনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সারা বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশ যেমন- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং মিশরে লক্ষ লক্ষ মুসলমান ছাগল, ভেড়া বা গরু জবাইয়ের ঐতিহ্যবাহী ঈদের অনুশীলন 'কুরবানি' তে অংশগ্রহণ করে । মুসলমানরা ঈদুল আজহা’র এই দিনে পশুগুলোকে কোরবানি হিসেবে জবাই করে, যা ইসলামী আইনে নির্ধারিত, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরষ্কারের জন্য করা হয় বলে বিশ্বাস করা হয় । ইসলামিক আইনে পশু জবাইয়ের রীতিতে সুনিদিষ্ট নিয়মাবলী আছে যা পশু জবাইয়ের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানবিক উপায়ের নিশ্চয়তা দেয় বলে ইসলামে বিশ্বাসীরা মনে করে। ইসলামি আইন মানুষকে নৃশংস বা অপমানজনকভাবে পশু জবাই করা থেকে বিরত রাখে । তা যাই হোক, বাংলাদেশের মত অনেক দেশেই ঈদুল আজহা’র সময়ে পশু জবাইর ক্ষেত্রে ইসলামী আইনে নির্ধারিত নিয়ম সঠিক ভাবে মেনে চলে না, যেমন- রাস্তায় বা রাস্তার পাশেই পশু জবাই করা এবং জবাইয়ের আগে সঠিকভাবে পশুকে সংযত (PROPER RESTRAIN) না করে জবাই করা, যা সত্যিকার অর্থে অমানবিক । সম্প্রতি মিশরীয় সরকার ঈদুল আজহা’র সময় পশু জবাই সংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে যে, রাস্তায় পশু জবাই করা অবৈধ এবং এটি ইসলামী আইনের পুরোপুরি লঙ্ঘন। মিশরের বৃহত্তম মুসলিম পথ নির্দেশক “আল-আজহারের (AL-AZHAR)” সাথে সম্পৃক্ত “দার আল ইফতা (DAR AL IFTA)”নামক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সাম্প্রতিক একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে যাতে এটি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, রাস্তায় পশু জবাই করা ইসলামে “পাপ” বলে বিবেচিত হয় এবং এই ভাবে যত্রতত্র পশু জবাই করলে এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে রোগ ছড়াতে পারে।

আমি আশা করি ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সকল প্রকার পশু জবাইয়ের পুর্বে একজন রেজিস্টার্ড ভেটেরেনারীয়ান কতৃক প্রত্যায়িত হবে যে পশুটি সুস্থ সবল, মান সম্পন্ন উপায়ে পশুটিকে RESTRAIN করা এবং জবাই করা হবে। জবাইয়ের পরে ভেটেরেনারীয়ান দ্বারা POST-MORTEM পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হবে যে, জবাইকৃত পশুটি থেকে প্রাপ্ত মাংস মানুষের খাদ্য হিসেবে গ্রহন করা নিরাপদ। পশু জবাইখানাটি অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন  ও স্বাস্থ্যসম্মত হবে এবং সেখানে কর্মরত সকল কর্মচারী স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াকরণ এর সকল বিধিমালা মেনে চলবে। আরও আশা করি যে, মাছ, মাংস, ডিম এবং দুধ জাতীয় খাদ্য দ্রব্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক (AIR CONDITION) কক্ষে বেচা বিক্রী হবে (যে দেশে জুতা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক কক্ষে বিক্রি হয় কিন্তু পচনশীল খাদ্য দ্রব্য যেমন মাংস বা মাছ খোলাবাজারে বা ময়লাযুক্ত নালা নর্দমার ধারে হয়। কিন্তু বাস্তবতায় উল্টো হওয়ার কথা ছিলো। এটাএকটা দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক এবং আমি আশা করি বাংলাদেশের এই সেক্টরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গগণ এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন)। এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রনালয় এবং মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রনালয় কৃষিজাতীয় খাদ্য (CROP, FISH, LIVESTOCK) দ্রব্যের উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রন, খাদ্য পণ্যের স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করার উদ্যোগ নিবেন এবং ভোক্তাদের জন্য গুণগত মান সম্পন্ন খাদ্য দ্রব্যাদি বাজারে যাতে থাকে এবং বিক্রয় হয় সে ব্যাপারে মূখ্য ভূমিকা পালন করবেন।

 

লেখকঃ বিমল চন্দ্র রায়, পি এইচ ডি (জাপান), পোস্ট ডকটোরাল ফেলো (জাপান, ক্যানাডা)।

গবেষণা সহযোগী

ইউনিভার্সিটি অফ আলবার্টা(CARCASS AND MEAT SCIENCE LABORATORY)

এডমন্টন, আলবার্টা, ক্যানাডা ।

 

?>