প্রাণিসম্পদ সেক্টর বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং জনগণের খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণে প্রাণিসম্পদ একটি প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের মানুষের দৈনন্দিন পুষ্টির একটি বড় অংশ আসে প্রাণিসম্পদ থেকে। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি—এগুলো থেকে প্রাপ্ত মাংস ও ডিম মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, প্রাণিসম্পদ থেকে নিরাপদ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে প্রাণিসম্পদ সেক্টরের একটি সার্বিক রিফর্ম এবং উন্নতমানের ভেটেরিনারি সার্ভিস নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ভেটেরিনারি সার্ভিসকে জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্ত করা, ইউনিয়ন লেভেলে ভেটেরিনারি সার্জন নিয়োগ এবং আধুনিক ভেটেরিনারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এই সেক্টরের পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ভেটেরিনারি সার্ভিসের গুরুত্ব
মানুষের রোগের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, প্রায় ৭০-৭৩ শতাংশ, প্রাণী থেকে আসে। পশুপাখিবাহী রোগ মূলত একধরণের সংক্রামক রোগ যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস কিংবা শৈবালের আক্রমণে হয়ে থাকে। এগুলো নানা ধরনের প্রাণী থেকে মানুষের মাঝে ছড়ায়।[১][২][৩] এই ধরনের রোগগুলোকে "জুনোটিক" রোগ বলা হয়, যা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে। যেমন, বার্ড ফ্লু, রেবিস, অ্যানথ্রাক্স, এবং আরো অনেক জুনোটিক রোগের উদাহরণ রয়েছে। বর্তমানের মারাত্মক রোগ যেমন ইভোলা ও স্যামোনেল্লোসিস হলো পশুপাখিবাহী রোগ। এইডসও একসময় পশুপাখিবাহী রোগ ছিল যেটি ২০শতাব্দীর দিকে মানব শরীরে প্রবেশ করে। বর্তমানে এইডস শুধু মানব শরীরেই হয়। যে ইনফ্লুয়েঞ্জা মানুষকে আক্রান্ত করে তা মূলত মানুষের রোগ কিন্তু বার্ড ফ্লু এবং সোয়াইন ফ্লু পশুপাখিবাহী রোগ; এই ভাইরাসগুলো নানা সময় মানুষের ফ্লুর সাথে মিলিত হয়ে ঝুঁকি তৈরি করে যেমন ১৯১৮ স্প্যানিশ ফ্লি বা ২০০৯ সোয়াইন ফ্লু।[৪] পশুপাখিবাহী রোগ বিভিন্ন উপায়ে হতে পারে যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং শৈবাল।[৫] বেশিরভাগ মানব রোগ অন্য প্রাণীতে উৎপন্ন হয়েছে।[৬]
২০২০ সালে করোনাভাইরাস নামক একটি ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করে। এটি একটি পশুপাখিবাহী রোগ যেটি পশু থেকে মানুষের মাঝে এসেছে। এই ভাইরাস এতোটাই ছোঁয়াচে যে লাখো মানুষ এতে আক্রান্ত হয় এবং সারা বিশ্বে মহামারী দেখা দেয়। করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়। তবে অনেকের সন্দেহ যে এই ভাইরাসটি চীন সরকার তার দেশের গরিব জনগনকে শেষ করে দেওয়ার জন্য নিজেরাই তৈরি করে নিজেরাই ছড়িয়ে ছিলো।[৭] এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে এসএআরএস-সিওভি-২’ পাওয়া যায়(যা বর্তমানে সাধারণত নোভেল করোনাভাইরাস নামেই পরিচিত। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।[৮] ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রামণ দেখা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ নামকরণ করে। ২০২০ সালের ১৪ই মে পযন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ২১৩টিরও বেশি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলে ৪৪ লাখ ৮০ হাজার-এরও বেশি ব্যক্তি করোনাভাইরাস রোগ ২০১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন বলে সংবাদ প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। বর্তমানে ৩ লাখ -জনের বেশি ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে এবং ১৬ লাখ ৮৪ হাজার এর- বেশি রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছে। এই ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে লকডাউন জারি করা হয়। এ কারণে, মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রাণীদের রোগ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। প্রাণীদের রোগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শুধুমাত্র প্রাণিসম্পদের স্বাস্থ্য রক্ষা করা হয় না, বরং মানুষের মধ্যে রোগের সংক্রমণও প্রতিরোধ করা যায়। উন্নত ভেটেরিনারি সার্ভিস, নিয়মিত টিকা কার্যক্রম, এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রাণীদের রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। এর ফলে, মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা যায় এবং রোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়। তাই, মানবস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রাণীদের রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং এ সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাণিসম্পদ সেক্টরে ভেটেরিনারি সার্ভিস একটি অপরিহার্য অংশ। উন্নতমানের ভেটেরিনারি সেবা প্রদান করা গেলে, প্রাণিসম্পদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব হয়, যা মানুষের জন্য নিরাপদ এবং পুষ্টিকর আমিষ সরবরাহ নিশ্চিত করে। এজন্য ভেটেরিনারি সার্ভিসকে জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যেমন, মানুষ যখন অসুস্থ হয়, তখন যেমন জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তেমনি প্রাণিসম্পদের জন্যও জরুরি চিকিৎসা সেবা প্রয়োজন।
প্রাণিসম্পদ সেক্টরের চ্যালেঞ্জ
প্রাণিসম্পদ সেক্টর বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি। যেমন, অসুস্থতা ও রোগের প্রাদুর্ভাব, অপ্রতুল ভেটেরিনারি সেবা, এবং প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে সঠিক খাদ্য ও পুষ্টির অভাব। এই সমস্যাগুলো শুধুমাত্র প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করছে না, বরং মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করছে।
অসুস্থ গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি থেকে প্রাপ্ত মাংস বা ডিমে রোগ জীবাণু থাকতে পারে, যা মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে, সংক্রামক রোগ যেমন বার্ড ফ্লু বা এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, যা পোল্ট্রি থেকে মানুষে ছড়াতে পারে, এর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। এজন্য নিরাপদ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে, এই সেক্টরের মৌলিক চ্যালেঞ্জগুলোকে সমাধান করতে হবে।
ভেটেরিনারি সার্ভিসকে জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্তকরণ
প্রাণিসম্পদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হলে শুধু প্রাণিসম্পদই সুস্থ থাকে না, বরং মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়। বর্তমান সময়ে প্রাণিসম্পদের রোগবালাই এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার দ্রুত সমাধান করার জন্য ভেটেরিনারি সার্ভিসকে জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যেমন, মানবস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে জরুরি চিকিৎসা সেবা অপরিহার্য, তেমনিভাবে প্রাণিসম্পদ সেক্টরেও এটি অপরিহার্য হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে দেশের প্রাণিসম্পদকে সুরক্ষা দেওয়া এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে।
ইউনিয়ন লেভেলে ভেটেরিনারি সার্জন নিয়োগ
বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল গ্রামভিত্তিক এবং এখানকার প্রধান জীবিকা কৃষি ও প্রাণিসম্পদ নির্ভর। তবে, গ্রামীণ এলাকায় ভেটেরিনারি সার্জনের সংখ্যা অপ্রতুল। ইউনিয়ন লেভেলে ভেটেরিনারি সার্জন নিয়োগের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাণিসম্পদের জন্য জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এটি দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং সুলভ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিত করবে, যা জাতির স্বাস্থ্য ও কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর ফলে প্রাণিসম্পদের রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সহজতর হবে, যা প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে।
আধুনিক ভেটেরিনারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা
প্রাণিসম্পদের রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য আধুনিক ভেটেরিনারি হাসপাতাল অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পর্যাপ্ত এবং উন্নতমানের ভেটেরিনারি হাসপাতাল নেই, যার ফলে অনেক প্রাণিসম্পদ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় বা তাদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। আধুনিক ভেটেরিনারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উন্নতমানের চিকিৎসা, সার্জারি, এবং রোগ নির্ণয় সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হবে। এটি শুধুমাত্র প্রাণিসম্পদের জীবন রক্ষা করবে না, বরং দেশের অর্থনীতির জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
উপসংহার
প্রাণিসম্পদ সেক্টরকে রিফর্ম এবং দেশে নিরাপদ আমিষ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ভেটেরিনারি সার্ভিসকে জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্ত করা, ইউনিয়ন লেভেলে ভেটেরিনারি সার্জন নিয়োগ এবং আধুনিক ভেটেরিনারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা সময়ের অন্যতম প্রধান দাবি। এই পদক্ষেপগুলি প্রাণিসম্পদ সেক্টরের উন্নয়ন, জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা, এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তাই, দেশের প্রাণিসম্পদ সেক্টরকে আরও শক্তিশালী এবং টেকসই করার জন্য এই উদ্যোগগুলোকে অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা উচিত।
তথ্যসূত্র
- ↑ঝাঁপ দিন:ক খ "zoonosis"। মেরিয়াম-ওয়েবস্টার ডিকশনারি (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৯।
- ↑WHO। "Zoonoses"। ৩ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪।
- ↑"A glimpse into Canada's highest containment laboratory for animal health: The National Centre for Foreign Animal Diseases"। science.gc.ca। Government of Canada। ২২ অক্টোবর ২০১৮। ২০ জুন ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ আগস্ট ২০১৯। Zoonoses are infectious diseases which jump from an animal host or reservoir into humans.
- ↑Coral-Almeida, Marco; Gabriël, Sarah; Abatih, Emmanuel Nji; Praet, Nicolas; Benitez, Washington; Dorny, Pierre (৬ জুলাই ২০১৫)। "Taenia solium Human Cysticercosis: A Systematic Review of Sero-epidemiological Data from Endemic Zones around the World"। PLOS Neglected Tropical Diseases। 9 (7): e0003919। আইএসএসএন 1935-2735। ডিওআই:1371/journal.pntd.0003919। পিএমআইডি 26147942। পিএমসি 4493064 ।
- ↑Taylor LH, Latham SM, Woolhouse ME (২০০১)। "Risk factors for human disease emergence"। Philosophical Transactions of the Royal Society B: Biological Sciences। 356 (1411): 983–989। ডিওআই:1098/rstb.2001.0888। পিএমআইডি 11516376। পিএমসি 1088493 ।
- ↑Marx PA, Apetrei C, Drucker E (অক্টোবর ২০০৪)। "AIDS as a zoonosis? Confusion over the origin of the virus and the origin of the epidemics"। Journal of Medical Primatology। 33 (5–6): 220–6। ডিওআই:1111/j.1600-0684.2004.00078.x। পিএমআইডি 15525322।
- Geller C, Varbanov M, Duval RE (নভেম্বর ২০১২)। "Human coronaviruses: insights into environmental resistance and its influence on the development of new antiseptic strategies"। Viruses। 4 (11): 3044–3068। ডিওআই:3390/v4113044। পিএমআইডি 23202515। পিএমসি 3509683 ।
- ↑"2019 Novel Coronavirus infection (Wuhan, China): Outbreak update"। Canada.ca। ২০২০-০১-২১।